একজন পিতা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প

http://www.gendercide.org/images/pics/bangla2.jpg
১২ই নভেম্বর,১৯৭১
সময়ঃ রাত ১২টা ১০(ক্যাপ্টেনের অফিস)

ক্যাপ্টেন আশফাক আলি টেবিল এর উপর পা তুলে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানছে, আজকে কতগুলা “মুক্তি” ধরা পড়েছে। আর খুনখারাপি ভাল্লাগেনা। কবে যে বোকাগুলা বুঝবে যে খামাখা যুদ্ধ করে লাভ নাই। একদিন পাকিস্তানি হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে হবে সারা বিশ্বে। তখন মনে করবে আমরা বলেছিলাম ভাল থাকতে, থাকল না। যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করবে। হুহ,মগের মুল্লুক পেয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান এক বোকা, আর সাথে কতগুলা বোকা বানিয়ে রেখে গেছে, এলএমজি নিয়ে যুদ্ধ করবে আমাদের সাথে, যারা কিনা অস্ত্র চালানতে সিদ্ধহস্ত। এই যে আজকে কতগুলা বোকা ধরা পরল। এত ডাস্টবিন পাবো কোথায় এদেরকে ফেলে রাখার জন্য। লাশের গন্ধে বাইরে যাওয়াটাই মুশকিল। শালা হারামি “বাঙ্গাল” গুলার লাশেও গন্ধ। নাপাক।
আজকের বাহিনীতে নাকি একজন বৃদ্ধ লোকও আছে, শালা কয়দিন বাকি আছে আর কবরে যাওয়ার, এখন নাপাকদের সাথে না ঘেঁষলে কি হত? সজোরে হাক দিল ক্যাপ্টেন-
-আমজাদ?
-জ্বি সাহেব?
-আজ কিতনে আদমিকো পাকড়া?
-গিনকে বাতানা পারেগা সাহাব।
-গিননে কি জরুরাত নেহি। কিতনে হো সাকতে হ্যায়?
-সাহাব, গুল মিলাকার ৫-৬ আদমি হোগা।
-ঠিক হ্যায়, লেকে আও হারামিয় কো।
শালা “মুক্তি”। এত মানুষ মরে এদের জ্ঞান হয়না।
সবাইকে ভিতরে নিয়ে আসা হয়েছে। ৪টা জওয়ান, একটা বুড়া।কারো চোখে ভয়ের ছাপ নেই। এগুলোর ভিতরে যে কিসের রক্ত বইছে কে জানে? হিন্দুদের সাথে থাকতে থাকতে ইমান ভুলে গেছে।
নাহ, এদেরকে দেখলেই ঘৃণা হয়, আল্লাহর রাস্তা ছেড়ে এখন মালাউনদের রাস্তা ধরেছে। ছেলেগুলা নাহয় বয়সের দোষে গেছে,কিন্তু বুড়াটা? ও তো বোঝে, ছেলেগুলাকে বুঝাতে পারেনা, মুজিব একটা কাফির, ওর দেখানো রাস্তায় যাতে না চলে।
বুড়াটা দেখি হাসছে। রাগে গা জ্বলে গেল ক্যাপ্টেনের।
-হেই বুডঢা, কিউ হাসতা হ্যায়। তেরা শাদি হ্যায় কিয়া?
-নেহি সাহাব, হাম মুক্তি নেহি হ্যায়। হাম তো শান্তিবাহিনী কা লোগ হ্যায়।
- কিয়া? তো তুম লোগনে পাহেলে কিউ নেহি বোলা?
-সাহাব পাহেলে বলতে তো আপসে মুলাকাত কাইসে হোতা?
-ইয়ে সাব বান্দে কিয়া তুমহারে সাথ হ্যায়।
-হা সাহাব লেকিন ইসকো ম্যায় নেহি জানতা।
-ঠিক হ্যায় তুম লোগ যাও, ইসসে ম্যায় লিপাটতা হু।
শালার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আগে থেকেই ভয় পাচ্ছিল সালা। এইটাকে মারার জন্য আর গুলি খরচ করা লাগবে না। বেনয়েত টা অনেকদিন কাজে লাগছে না। আজকে ব্যাবহার করতে হবে।
সময়ঃ রাত ১২টা ১০(জেলখানার ভিতর)
শাফায়েত হোসেন তার বাসায় কিছু ছেলেপেলেদের খাওয়াতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। তার নিজের ছেলে অনিককে অনেক ভালবাসেন বলে যুদ্ধে যেতে দেননি, তার জন্য বাকিদেরকেও তিনি নিজের ছেলের চেয়ে কোন অংশে কম ভালবাসেন না। ছেলেগুলো মনেহয় দেশটা স্বাধীন করবেই। কিন্তু এখন তো বের হওয়ার একটা উপায় বের করতে হবে। উনার মাথায় তো একটা বুদ্ধি ঘুরপাক খাচ্ছে। বাকিদেরকেও সেটা জানানো উচিত।
-তরুণ, শোন।
-জি চাচা বলেন?
-এই নরক থেকে বের হওয়ার জন্য একটা বুদ্ধি বের করেছি।
-কিন্তু করতে কি হবে?
- ওই কুত্তাগুলা যখন আমাদের ডাকবে তখন ওদের সামনে বলতে হবে আমরা শান্তিবাহিনীর লোক। আর হ্যা, একদম স্বাভাবিক থাকতে হবে।
-জি চাচা, বুঝতে পেরেছি। আমি বাকিদেরকে বলে দিচ্ছি।
- আর হ্যা, ওই জায়গায় আমি ছাড়া আর কেউ যেন একটা কথাও না বলে।
-জি চাচা, আমি সবাইকে বুঝিয়ে দিব।
শালা পাকিস্তানিটা ডেকে পাঠিয়েছে। শাফায়েত সাহেব তার দল নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অফিসএ গেলেন। কিন্তু সেখানকার ঘটনা সম্পর্কে কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। উনি নিজের ছেলেকেই না চেনার ভান করলেন। তরুন নামের ছেলেটাসহ বাকি ছেলেগুলোও অবাক না হয়ে পারল না। ক্যাপ্টেন যদি ওই ছেলেটার দিকে না তাকিয়ে অন্যদের দিকে তাকাতো, তাহলে ভয় না দেখতে পেলেও বিস্ময়টা ঠিকই ধরা পরত।
জেল থেকে বের হয়ে শাফায়েত সাহেব একটা কথাও বললেন না। শেষমেশ তরুনই কথা শুরু করল।
-এটা আপনি কি করলেন চাচা? ও তো কিছুই করেনি।
-আমি সব বুঝেই করেছি। আমাদের মধ্যে কেউই মুক্তিযোদ্ধা নয় এই কথাটা বিশ্বাস করাটা ওদের কষ্টকর ছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা যেতো ওরা যেকোনো একজনকে জিম্মি রেখে বাকিদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। কারন একজন মানুষকে মেরে ওরা যদি ওদের বাপদেরকে দেখাতে পারে তাহলে তো ওদের জন্য আলাদা সুবিধা থাকবে। কে জানে, হয়তবা পদোন্নতিও হতে পারে। তাই একজনকে তো মুক্তিযোদ্ধা দেখানই লাগতো। আর অনিক এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। যায়নি বললে ভুল হবে আমি যেতে দেইনি। তোমাদের মধ্যে কাউকে ধরিয়ে দেওয়া মানে একটা মুক্তিযোদ্ধা কমিয়ে দেওয়া। তাই আমি ওকেই ধরিয়ে দিলাম।
তরুন আর কিছু বলল না, শুধু ওর বাহিনী নিয়ে চলে গেল। শাফায়েত সাহেবের কাছে অনেক সাহসী ছেলে ও। তাই চোখের জলটা ওনাকে দেখাতে চায়না।
এতক্ষন শাফায়েত সাহেব মুখে যা বলতে পারেননি তা অশ্রুফোটার মাধ্যমে বেরিয়ে এল। পৃথিবীতে কেউ এই ভাষা বুঝতে সক্ষম নয়। কিন্তু উপরে বসে একজন ঠিকই সেই ভাষাটা বুঝতে পারলেন। মা মরা ছেলেটাকে অনেক আদর করে মানুষ করেছিলেন। ছেলেটা প্রায় বলতো যুদ্ধে যাবে। তিনি যেতে দেননি। ছেলে বলতো দেশের জন্য কিছু করবে, আজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও হয়তবা তাকে দেশের জন্য কুরবান হতে হল।


১৪ই নভেম্বর,১৯৭১
সময়ঃ দুপুর ১টা ১৭ মিনিট (ক্যাপ্টেনের অফিস)
শাফায়েত হোসেন বসে আছেন ক্যাপ্টেন আশফাক আলির সামনে। উদ্দেশ্য ছিল ২ টা এখানে আসার, ১ম উদ্দেশ্য- ছেলের লাশ কোথায় আছে তা যদি কৌশলে বের করা যায়। ২য় উদ্দেশ্য, ক্যাপ্টেনকে বাসায় দাওয়াত দেয়া।
-সাহাব কাইসে হ্যায় আপ?
-হাম ঠিক হ্যায়।তুম কায়সা হ্যায়?
-আপ লোগো কি মেহেরবানি সে ঠিক হু। সাহাব উস কুত্তে মুক্তিকো কিয়া মার দিয়া?
-হা মার দিয়া হারামিকো।
-লাশ কাহা গিরায়া সাহাব?
-পাতা নেহি, হোঙ্গি কাহি নালে পে। তো তুম ইয়াহা আয়ে কিউ?
- সাহাব, হাম আপকো দাওয়াত দেনে আয়ি হু। কাল রাত আপ মেরে গারিবখানে মে আকার মুঝে আপকা আভারি কিজিয়েগা।
-হা হা হা হা। তুম লোগ ভি। তো সাথ মে আয়েশ কা বন্দোবস্ত হ্যায় তো?
-হা সাহাব। আপ চিন্তা মাত কিজিয়ে। সাব কুছ ইন্তেজাম হ জায়েগা।

১৬ই নভেম্বর, ১৯৭১
সময়ঃ রাত ৯টা(শাফায়েত সাহেবের বাসা)

ক্যাপ্টেন শাফায়েত সাহেবের বাসায় এসেছে, কিন্তু কোন আয়োজন দেখতে পাচ্ছে না। উনাকে জিজ্ঞেসও করেছিল। উনি অপেক্ষা করার কথা বলে ভিতরে গেলেন। আর কোন খবর নাই।
হঠাৎ করেই ৪-৫টা ছেলে এসে তাকে জাপটে ধরল। চিত করে মাটিতে শুইয়ে দিল। অইসময় শাফায়েত সাহেব ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। ক্যাপ্টেনের আর বুঝার কিছুই বাকি রইল না। শুধু ভয়াল দৃষ্টিতে শাফায়েত সাহেবের বাঘের মত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। বাংলায় জানি চেচিয়ে কি বলল শাফায়েত সাহেব। ক্যাপ্টেন তা বুঝতে পারল না।
শাফায়েত সাহেব বলছিল,”রাশেদ, ছুরিটা নিয়ে আয় ত,অনেকদিন কোরবানি দেওয়া হয়না।“



পরিশিষ্টঃ শাফায়েত সাহেব ধরা পড়েন ৩ ডিসেম্বর। পাকিরা তাকে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তার শরীর থেকে প্রতিদিন মাংস কেটে নিয়ে কুকুরকে খাওয়ানো হত। এই যন্ত্রণা তিনি দেড় দিন সহ্য করেন। কিন্তু একবারও কুত্তাগুলার কাছে প্রানভিক্ষা চাননি। ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। 
মূল লেখা: http://www.somewhereinblog.net/blog/invisiblestatue/29549775

Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved