ফজরের আজানের সময় হত্যা করা হয়েছিলো মাদ্রাসা শিক্ষক ও বৈতাপাড়া মসজিদের (ভালুকা, ময়মনসিংহ) পেশ ইমাম ছফিরউদ্দিন মুন্সীকে। তার অপরাধ তার ধর্মচর্চা জামাতে ইসলামীর ভন্ডামির অনুকুলে ছিলো না। ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই মঙ্গলবার ভোরে শান্তি কমিটির ওই দালালেরা প্রায় ৩০ জনের একটি পাকিস্তানী সেনাদলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। ছফিরুদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দেওয়া হয় সবাইকে। সদ্যই অজু করা ছফিরউদ্দিন এবং তার
স্ত্রী নছিমুন্নেসা বেরিয়ে আসেন। তাদের সঙ্গী হন পাশের ঘরের ভাই ডাঃ আবদুস ছামাদ ও তার স্ত্রী খাদিজা বেগম। সবাইকে উঠানে লাইন ধরে দাড়াতে বলা হয়।
দালালরা তাদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে । পাকি অফিসার উর্দুতে উচ্চারণ করে ছফিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ যা বাংলায় তর্জমা করে দেয় এক দালাল। বলা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সহায়তা করেন ছফিরউদ্দিন এবং তার বাড়িতে তারা আশ্রয় নেয়। ছফিরউদ্দিন এই অভিযোগ অস্বীকার করেন, জানান তিনি একজন ইমাম, তিনি মিথ্যা বলেন না। কিন্তু দালালেরা চেচিয়ে বলে তাদের কাছে প্রমাণ আছে। পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে কসম খেয়েও রেহাই পান না দুই ভাই। এরপর লাইন ধরে গুলি করে মারা হয় তাদের সবাইকে। খাদিজা বেগমের দুই বছর বয়সী মেয়ে রোকেয়া হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে ছুটে আসে বুকের দুধ খেতে। তাকে তুলে নিয়ে এক দালাল ছুড়ে মারে পাশের ধানের গোলায়। দৈবক্রমে বেচে যায় রোকেয়া।
এই তালিকায় আরেকজন শহীদ আছেন। তার নাম আবদুল করিম। আবদুস ছামাদের ১৫ বছর বয়সী এই কিশোর পুত্র ঘরের জানালা দিয়ে দেখে এই নৃশংস গণহত্যা। সে একটা ছুরি নিয়ে ছুটে আসে, বসিয়ে দেয় একজন পাকিস্তানী সৈন্যের পেটে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকেও। এরপর ছফিরউদ্দিনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এবং সেই আগুনে ছুড়ে দেওয়া হয় ৫টি লাশ। পাঁচজন শহীদকে।
পাকিস্তানীরা আসার পরপরই আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো সারা গ্রাম। সন্ধ্যায় গ্রামবাসী ফিরে এসে তাদের সমাহিত করে রুপি নদীর পাড়ে। এরপর জানা যায় আসল ঘটনা। ঘটনার কদিন আগে একদল ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলেন ছফিরউদ্দিনের দরজায় যদি কিছু খাবার মিলে। ছফিরউদ্দিন তাদের ফেরাননি, ঘরে থাকা সামান্য ডাল ও ভাত তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীন মানচিত্র ও পতাকার জন্য জীবনবাজি রাখা সেই তরুণদের। কে জানতো এজন্য এত বড় মূল্য চুকাতে হবে ইমাম সাহেব ও তার পরিবারকে।
সেই সন্ধ্যায় গ্রামবাসী পাঁচটি দগ্ধ লাশের সঙ্গে পেয়েছিলো ৫টি পোড়া কোরআন শরীফও। এগুলো তেলওয়াতের জন্য ব্যবহার করতেন ছফিরউদ্দিন। সেই পোড়া কোরআন জানান দিয়ে যায় ধর্মের নামে যারা পাকিস্তানীদের দালালী করছে, ইসলাম রক্ষার জন্য যারা নিজেদের আল্লাহর সৈনিক বলে দাবি করে, সেই জামাতে ইসলামীর সদস্যরা আসলে কত বড় মোনাফেক।
কৃতজ্ঞতা : লে. কর্ণেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক এবং অমি রহমাল পিয়াল
Post a Comment