*গোপালপুর গণহত্যা- যে বিভীষিকা আজো বর্তমান নাটোরবাসীর হৃদয়ে


প্রথমেই অনুরোধ করবো লেখাটি পুরোটা না পড়লেও অন্ততে শেষের ভাগটি পড়ুন। এই লেখাটি পড়লে অন্তত বুঝতে পারবেন আমাদের সেই একাত্তরের প্রজন্মের আমাদের স্বাধীনতার জন্য কতটুকু আত্মত্যাগ করেছিল এবং কী ধরনের প্রতিকূল এবং বিপদসংকুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছিল।

=============


একাত্তরে পাকবাহিনী আমাদের উপর যে বর্বরতা চালিয়েছিল তা গত শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিদিন ইচ্ছেমত মানুষ ধরে নিয়ে যাওয়া হতো আর লাইনে ধরে দাঁড় করিয়ে গুলী করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো বা গর্ত করে পুঁতে ফেলা হতো সেসব লাশ।

একাজে পাকিস্তানীদের সহায়তা করতো আমাদের দেশীয় কিছু বরাহশাবক যারা রাজাকার,আলবদর এবং জামায়াতে ইসলামী নামে পরিচিত। আমাদের দেশব্যাপী এই ধরনের বেশ অনেকগুলো গণকবর এবং বধ্যভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আর আছে সেসব বিভীষিকার সাক্ষী কিছু মানুষ যারা ভাগ্যক্রমে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন সেসব বধ্যভূমি থেকে।

=============

এরকম একটি গণহত্যা গোপালপুর গণহত্যা। এই গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৫ মে নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার অন্তর্গত গোপালপুর সদরে। এই গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ চিনিকলে কর্মরত বাঙালিরা।

বাঙালি প্রতিরোধের উত্তরে, রাজশাহী অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদরদফতর থেকে স্থলপথে ও আকাশপথে শক্তিদল দ্রুত প্রেরণ করে। সেনাবাহিনী ত্বরিতগতিতে পাবনা, ঈশ্বরদী ও নাটোরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে সক্ষম হয়। ৫-ই মে, ১৯৭১ তারা গোপালপুর পৌঁছায় এবং বাঙালিদের শক্ত ঘাঁটি চিনিকল দখল করে ফেলে। প্রায় ২০০ বাঙালি জনগণ যারা মূলত চিনিকলের কর্মচারী ছিল, সবাইকে জড়ো করা হয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

যোদ্ধাদের নেতা অবসরপ্রাপ্ত লে. আনোয়ারুল আজিম সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন এবং অনুরোধ করেন যেন নিরীহ লোকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেনারা লে. আজিম ও তার পরিবারকে গুলি করে। বন্দী কর্মচারীদের চিনিকলের ভিতরে একটি পুকুরের সামনে লাইনে দাঁড় করানো হয় এবং গুলি করে মারা হয়। গুলিবিদ্ধ ২০০ জন বন্দির মাঝে মাত্র চারজন- আবদুল জলিল শিকদার, খরশেদ আলম, আবুল হোসেইন, ইমাদ উদ্দিন এবং ইঞ্জিল সর্দার বাঁচতে সক্ষম হন।

মৃতদেহগুলোকে পুকুরে নিক্ষেপ করা হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুকুরটির নামকরণ করা হয় 'শহীদসাগর।' গোপালপুর রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করা হয় 'আজিমনগর স্টেশন,' অবসরপ্রাপ্ত লে. আজিমের স্মরণে।

=============

সেদিন সেই গোপালপুর গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে এসেছিল জালাল আহমেদ। তার সেদিনকার সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা জানতে পড়ুন নিচের সাক্ষাতকারটি যা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয় ।

=============

বুকে ও পিঠে বেয়নেটের আঘাতের কালো দাগ। দুই চোখে বিষাদের ছায়া। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বুলেটবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান খন্দকার জালাল আহমেদ। নাটোরের লালপুর উপজেলার নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের তত্কালীন এই কর্মকর্তা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন যুদ্ধদিনের দুঃসহ স্মৃতি।

নাটোর সুগার মিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জালাল আহমেদের বর্ণনায়, “১৯৭১ সালের ৫ মে সকাল সাড়ে ১০টায় দায়িত্ব পালন করছিলাম। দুজন পাকিস্তানি সেনা আমার দুই পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বলল, ‘ইয়ে বাঙালি, মিটিং মে চল’। এ সময় মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা মঞ্জুর ইমান নামের একজন অবাঙালি কর্মচারী বাঙালিদের শনাক্ত করে দিচ্ছিল।

এর মধ্যে মিলের কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিমকেও ধরে আনা হয়। একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা আজিমকে বলে, ‘কিসনে মেজর আসলামকে মারা হায়’? তিনি বলেন, জানি না। আজিম এ সময় হানাদারদের সঙ্গে তর্ক শুরু করেন। পরে নরপশুরা আমাদের মিলের অফিসার্স কোয়ার্টারের পুকুরঘাটে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাতকদের ১৩টি স্বয়ংক্রিয় এলএমজি একসঙ্গে আমাদের ওপর গর্জে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে পুকুরঘাট লাশের স্তূপে পরিণত হয়।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মিলে কর্মরত প্রায় ২০০ শ্রমিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে আমাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পানির মধ্যে গড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। একসময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মাথাটা ঘাটের ওপর এবং দেহের অর্ধেক অংশ পানির মধ্যে ডুবে আছে। লাশের স্তূপের মধ্যে উল্টে-পাল্টে জীবন্ত কাউকে খুঁজছিলেন আমার সহকর্মী মেহমান আলী। বুঝলাম, তিনিই আমাকে লাশের স্তূপ থেকে উদ্ধার করেছেন। বহু কষ্টে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম, পাশে পড়ে আছে ছোট ভাই মান্নানের লাশ। হত্যার আগে ও আমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল।”

জালাল আহমেদ জানান, ব্রাশফায়ারের আগ মুহূর্তে মান্নান নামের মিলের এক হিসাব সহকারী শায়িত অবস্থায় মাথাটা সামান্য উঁচু করে পবিত্র কোরআন পাঠ করছিলেন। তাঁকে দেখে হানাদারেরা বলে, ‘তুম মৌলবি হু? ছোড় দাও।’ তখন তিনি বলেন, ‘আমি একা যাব না। সবাইকে ছাড়।’ হানাদারেরা তখন মান্নানকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পুকুরে অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।


এই সেই পাকবাহিনী,এই সেই রাজাকার। যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করে । অথচ কুরআন শরীফ পরা অবস্থায় থাকা এক মৌলভীও তাদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। তারা এখন আবার সোর তুলে এদেশে কোণ গণহত্যা হয়নি, কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট এসব কীটদের জন্য ঘৃণা জানানোর ভাষাও আমার নেই।

কী সহজ তাই না এতগুলো প্রাণ শেষ করে দেওয়া? একটি স্বাভাবিক মানুষ এক সাথে এত কুকুর মারতেও দ্বিতীয়বার ভাববে। এবার বুঝুন আমাদের বাঙ্গালীদের পাকিস্তানীরা কোন চোখে দেখতো। এদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি,প্রতিটি ঘাসের পেছনে আছে সেইসব শহীদদের রক্ত। আসুন আমরা তাদের রক্তের ঋণ এবার শোধ করি। এদেশকে তাদের স্বপ্নের দেশের মত করে গড়ে তুলি।







মূল লেখা: https://www.facebook.com/Muktijuddhergolpo
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved