*ঘরে না ফেরা এক সালামের গল্প

একাত্তরে সালাম ছিল বাবার আদরের সন্তান, মায়ের নয়নমণি আর শাসন থেকে বাঁচতে দুষ্ট ছোট ভাই-বোনের মমতাময়ী আশ্রয় । তার বাবা ছিলো ইপিআরের সুবেদার মেজর। চার জনের ছোট্ট এই মধ্যবিত্ত পরিবারে অর্থের টানাটানি থাকলেও ছিলনা সুখের কমতি। এভাবেই চলছিল বেশ। 

কিন্তু কী যে কি হলো এরই মাঝে এলো সেই ভয়াল ২৫শে মার্চ, 
১৯৭১। নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর ঝাঁপিয়ে পরা পাকবাহিনী, সালামের বাবার খোঁজেও হানা দিল তাদের বাড়িতে। সালামের চোখের সামনেই নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে তার প্রিয় পরিবার। একে একে বাবা-মা, ছোট্ট ভাই-বোন সবাইকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানীরা। দূর থেকে দেখে লুকিয়ে বাঁচে সালাম। কল্পনা করুন তো একবার তার মনের অবস্থা? নিজেকে কল্পনা করুনতো আপনি আছেন লুকিয়ে, কিন্তু আপনার সামনেই একে একে হত্যা করা হচ্ছে আপনার পরিবারের সবাইকে? কী বুঝতে পারছেন তার মনের অবস্থা?

তাই অনুভূতিশূন্য সালাম প্রতিশোধ উন্মুখ সালাম পালাবার পরই সোজা আসে অষ্টম ইস্ট-বেঙ্গলে। রক্ত চাই তার, রক্ত। পাকিস্তানীদের রক্ত। কিন্তু চাইলেই কি হয়? বাধ সাধলেন কোম্পানী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন আমিন, এত অল্প বয়সী কাউকে দলে নিতে রাজী নন তিনি। কিন্তু তবু সালাম মিশে যায় দলের সাথে, আমীনের অনুপস্থিতে লুকিয়ে শিখে ফেলেন অস্ত্র চালনাও।

এরই মাঝে ক্যাপ্টেন আমীন পরিকল্পনা নেন এক দুঃসাহসিক অভিযানের। পাকিস্তানীদের শক্ত ঘাঁটি শেরপুর জেলার নকশী বিওপি আক্রমণ করবেন তিনি। ডিডে ঠিক করা হয় ৩ আগস্ট। আমীনের অধীনে আছে ৩০০ সৈন্যের একটি দল, যাদের বেশীরভাগই অল্প ট্রেনিং পাওয়া সাধারণ ছাত্র, কৃষক। মাত্র ২১ জন আছে পুরনো সৈনিক যাদের সামরিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। অপরদিকে পাকবাহিনী নকশীতে বানিয়েছে শক্ত ঘাঁটি। চারপাশে কাঁটাতার আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সুরক্ষিত, আছে মাইনফিল্ডও। দৃষ্টিসীমা যেদিকে যায়, ততদূর পর্যন্ত পাহারা দিয়ে রেখেছে তাদের মেশিনগ্যান।

নির্ধারিত দিনে, ভোর চারটায় আক্রমনের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে সৈন্যদের ব্রিফ করবার সময় আমীন খেয়াল করলেন সালামও একটি রাইফেল যোগাড় করে এসেছে তাদের সাথে এবং আমীনের দৃষ্টি এড়িয়ে লুকিয়ে থাকবার চেষ্ঠা করছে, যুদ্ধে যেতে দেবে না এই ভয়ে। এতটুকু ছেলে, যুদ্ধের সে কী বোঝে? কিন্তু বোঝে এই দেশকে মুক্ত করতে হলে অস্ত্রের বিকল্প নেই, পাঞ্জাবী নিধনের বিকল্প নেই। শুরু হলো আক্রমণ, কিন্তু প্রথমেই বিপত্তি।

ভারতীয় আর্টিলারীর গোলা ভুল পজিশনে এসে, পাকবাহিনীর পরিবর্তে, আমাদের ছেলেদের উপরেই পড়ছে। আর এই শব্দে সতর্ক হয়ে পাকিস্তানীরাও শুরু করলো মর্টার আর আর্টিলারী ফায়ার। দুই দিকের এই আক্রমণে বিপর্যস্ত আমাদের যোদ্ধারা। তবু চলবে না পিছিয়ে যাওয়া। স্বল্প প্রশিক্ষিত মাটি কামড়ে থাকা এই দলকে অনেক কষ্ট করে পুনরায় সংঘটিত করে আমীন আক্রমণ শুরু করেন সম্মুখে থাকা পাকবাহিনীর বাঙ্গারের দিকে। শুরু হয় "জয় বাংলা" ধ্বণিতে বাংলার অকুতোভয় যোদ্ধাদের আক্রমন। কিন্তু এবারোও বিধি বাম, কোন ভাবেই আসছেনা সাফল্য। পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণে এক সময় বহু হতাহত সহ পিছিয়ে যেতে থাকে আমাদের ছেলেরা।

হানাদারদের পোঁতা ধারালো কঞ্চি পা এফোঁড় ওফোঁড় করেছে অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আমীনের। পা চেপে পড়ে আছেন, মাটিতে। এক সময় হাতেও লাগে একটি গুলি। এক পাকিস্তানী সৈন্য বুঝে ফেলে মুক্তিবাহিনীর এক অফিসার এমন দুরবস্থায় আছে। তাই মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব পুরোপুরি ভেঙ্গে দিতে আমীনের দিকে বেয়নেট ঊঁচিয়ে এগিয়ে আসে সে।

নিশ্চিত মৃত্যু জেনে চোখ বুজে থাকা আমীনের জন্য অপেক্ষা করছিল এক বিস্ময়। শত্রু আর তার মাঝে এসে পড়ে সালাম এবং নিজের শরীর থেকে ভারী ওজনের এক রাইফেল দিয়ে গেঁথে ফেলে সে দশাসই সেই পাকিস্তানী সেনাকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমীন। এদিকে আহতদের বয়ে নিয়ে একে একে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যাচ্ছে আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে। কিন্তু সালামের ইচ্ছে নেই পশ্চাদপরণের। ভারী রাইফেল ফেলে তুলে নয়, পাশের আরো ভারী ২০ কেজি ওজনের এক এলএমজি।

তারপর? সালাম সেই এলএমজি নিয়ে দৌঁড় দেয় পাকিস্তানীদের বাঙ্কারের দিকে। পেছন থেকে আমীন ডেকে চলছেন সালাম ফিরে এসো, বোকামী করো না। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকানো হয় না সালামের। তার চোখে তখন জ্বলজ্বল করছে প্রতিশোধের আগুন, চীৎকার করে চলেছে "তোরা আমার বাবা-মা, ভাই-বোনকে মেরেছিস? ভেবছিস, আমি কি তোদের এমনিতেই ছেড়ে দেব?"

দৌঁড়ে এক সময় সালাম অদৃশ্য হয়ে যায় পাকিস্তানীদের বাঙ্কারের দিকে, আমীনের চোখের আন্তরালে। আর ফেরা হয়নি সালামের। এরই মাঝে আজ পেরিয়ে গেছে ৪১টি বছর,আমীন আহমেদ ক্যাপ্টেন থেকে পরবর্তীতে হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেলও। তবু সেদিন সালামের বীরত্বে বেঁচে যাওয়া সেই আমীন আহমেদের কানে আজো প্রায় ভেসে আসে সালামের সেদিনের সেই চীৎকার, "তোরা আমার বাবা-মা, ভাই-বোনকে মেরেছিস? ভেবছিস, আমি কি তোদের এমনিতেই ছেড়ে দেব?"

------
তথ্যসূত্রঃ কিশোর যোদ্ধা সালাম



আগে প্রকাশিত:  https://১৪৫৪২৩৪৫




Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved