বলতে এসেছি এক পিতৃহারা কিশোরের প্রতিশোধের গল্প

নাম কি তর? মণ্ডল, আজিজ মণ্ডল। বাড়ী কই? মাঝিরা, এক্কেরে বগুড়ার ঠিক কাছে। এতদূরে কি করস? বাপ ভাইয়েরে পাকিস্তানীরা গুলী কইরা মারসে, আমি লুকাইয়া বাঁচছুইন। মায়েরে নিয়া এখানেই থাকি। 

এভাবেই নির্লিপ্ত কণ্ঠে ট্যাঙ্কের উপরের বসে থাকা হামিদুল হাসান তারেকের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল ১৪/১৫ বছরের
 এক ছেলে। নাম আজিজ মণ্ডল। বীর বিক্রম হামিদুল হাসান এবং তার দল সুখনপুর গ্রাম দিয়ে চলেছে ভারতীয় ৬ গার্ড রেজিমেন্টের সাথে, বগুড়ার পাকিস্তানীদের শক্ত ডিফেন্স আক্রমণে। ভোর বেলা সার সার ট্যাঙ্ক দেখে অবাক হয়ে বেরিয়ে আসে গ্রামবাসী, আসে মণ্ডলও। ভয় না পেয়ে ট্যাঙ্কের খুব কাছে এসেই একটি পতাকা ধরিয়ে দেয় হামিদুলের হাতে, এভাবেই শুরু হয় কথোপকথন।

বাবা-ভাইকে হারানোর পরে শোকে পাথর আজিজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় প্রতিশোধ গ্রহণের। পরিচয় হয় গ্রামের কাছে থাকা এক দল মুক্তিযোদ্ধার সাথে, শিখে নেয় গ্রেনেড চালনাও। এরই মাঝে আজিজ একবার বগুড়া পুলিশ লাইন মাঠে গিয়ে দেখে সেখানে নিয়মিতই পাকবাহিনীর আড্ডা। বগুড়াতে শক্ত ঘাঁটি থাকায়, এই বাজারে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয় নেই। তাই আয়েশি ভঙ্গিতেই চলে তাদের আড্ডা। আর বাজার থেকে মাঝে মধ্যেই ধরে নেয় বাঙ্গালিদের, বিনা শ্রমে খাটায় নাটোর চৌরাস্তার দিকে নির্মাণরত রানওয়েতে। তাদের কাজ তদারকি এবং প্রহরায় থাকে একটি বড় সামরিক ট্রাকে ভর্তি পাকবাহিনী।

আজিজ মুহূর্তেই পরিকল্পনা করে এক দুঃসাহসিক আক্রমণের। অনেক কষ্টে মুক্তিযোদ্ধাদের ইনিয়ে বিনিয়ে জোগাড় করে দুটি গ্রেনেড। সেবার তাদের ক্ষেতে লালশাক হয়েছিল প্রচুর। তাই নিয়ে ঝুড়িতে করে, শাক বিক্রেতার ছদ্মবেশে এক শুক্রবার বাজারে আসে আজিজ। হাট বার হওয়াতে ইতিমধ্যেই বাজারে বেশ ভিড়, আর এই ভিড়ে গা ঢাকা দেবার সুবিধা হবে ভেবেই চতুর আজিজ বেছে নেয় এই দিনটি।

যথাসময়ে শাক বেচার পর খালি ঝাঁকা আর কোমরে গামছা দিয়ে প্যাঁচানো গ্রেনেড নিয়ে আজিজ ধীরে ধীরে অন্যান্য মানুষের দলের সাথে হেটে যেতে থাকে মোড়ে দাঁড়ানো পাকবাহিনীর তিন টনি ট্রাকের দিকে, যেখান নিশ্চিন্ত মনে গল্প করছে ৭/৮ জন পাকবাহিনী। কাছাকাছিই এসে আস্তে করে সে নেমে পড়ে রাস্তার পাশের জলায় এবং ঘুর পথে সবার চোখ এড়িয়ে জলার দিক থেকে এসে পড়ে একদম ট্রাকের ঠিক আছে।

এরপর লম্বা একটি দম নিয়ে পিন খুলে ছুঁড়ে মারল প্রথম গ্রেনেডটি। এরপরই ধুম করে প্রচণ্ড শব্দ, নরক নেমে এলো পাকিস্তানীদের উপর। ততক্ষণে দ্বিতীয় গ্রেনেডটিও উঠে এসেছে আজিজের হাতে। সময় নষ্ট না করেই পিন খুলে সেটিও ছুঁড়ে দিল অভেদ্য লক্ষ্যে। আবারো বাতাস ভারী হল পাকিস্তানীদের আর্ত চীৎকারে। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকা হাটের মানুষের সাথে পালিয়ে চলে এলো আজিজ। মৃত্যুর আগে পাকবাহিনী সেই দলটি বুঝতেই পারলো না, এক পিতৃহারা কিশোরের প্রতিশোধের বলী হল তারা। এখানেই কিন্তু আজিজের বীরত্ব শেষ নয়, পরবর্তীতে আবারো সে এমব্যুশ করে পাকবাহিনীকে, কিন্তু সেদিনের বীরত্বের কথা না হয় অন্যদিন বলা যাবে।

কিন্তু ভেবে দেখুন একবার, যে বয়সে আপনার আমার ছোট ভাইকে বাড়ীর সামনের রাস্তাটি পর্যন্ত পার করিয়ে দিই আমারা, সেই বয়সেই আজিজের মত অকুতোভয় হাজারো বীরেরা গ্রেনেড হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হানাদার বধে। দেশ বলতে কি বুঝে সেই ছেলেটি? কিন্তু তবু সে বুঝেছিল বাংলার বুকে নেই, পাকবাহিনীর ঠাঁই। কি সাহস! কি দেশপ্রেম! আজকের এই দিনে বসে ভাবা যায়? 


আগে প্রকাশিত: https://www.facebook.com/৬৫৪৬

Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved