আমাদের শিশু মুক্তিযোদ্ধারা

জুলাই মাসের শেষ অথবা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘরে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মতিন ও ক্যাপ্টেন হায়দার কী নিয়ে যেন আলাপ করছেন। মাঝেমধ্যে ম্যাপশিটে মার্কার দিয়ে আঁকিবুকিও করছেন। আমাকে মেজর খালেদ ডেকে পাঠিয়েছেন। দূরে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় একটি টেলিফোন এল। ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ডের 
কথা শুনে খালেদ বললেন, ‘সবাইকে চোখ বেঁধে রেখে
দাও।’ (পরে জেনেছি কয়েকজন কিশোর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ক্যাম্পে প্রবেশ করতে চায়। গেটে আরপি (Regimental Police) বাধা দিলেও কিশোররা পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আরপি ক্যাপ্টেন হায়দার এবং মেজর মতিনকে ফোন করে কাউকে না পেয়ে ছেলেদের অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু ছেলেরা আরপি হাবিলদারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বলে জানা যায়।

ঘণ্টা দুয়েকের আলোচনা শেষে মেজর খালেদ কোনাবন সাব-সেক্টরে যাবেন। আমাকে বললেন গাড়িতে উঠতে। জিপের পেছনে উঠে বসলাম। গাড়ি আরপি চেকপোস্ট পার হয়ে ১৫-২০ গজ পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ মেজর খালেদ গাড়ি পেছাতে বললেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় আট-নয়জন ১৪-১৫ বছরের কিশোর। খালেদ আরপি হাবিলদারের কাছে জানতে চাইলেন, কেন এদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। আরপি হাবিলদার বলেন, ‘স্যার, আপনিই তো এদের চোখ বেঁধে রাখতে বলেছেন।’

খালেদের এবার মনে পড়ল; আদেশ দিলেন ওদের চোখ খুলে দিতে। জিজ্ঞেস করলেন ওদের, ওরা কী চায়। মুহূর্তের মধ্যে সব কিশোর ক্রোধে মেজর খালেদের ওপর ফেটে পড়ল। ওরা আর্মি চেনে না, ওরা মেজর চেনে না, ওরা সেক্টর কমান্ডার কী জানে না। ওরা শুধু ওদের মাতৃভূমি চেনে। ওরা ওদের মাতৃভূমির ক্রান্তিকালে সহায় হতে এসেছে। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই, ‘আপনি আমাদের চোখ বাঁধার হুকুম দেওয়ার কে? আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে না দিলে আমরা অন্য জায়গায় যুদ্ধ করব। বাংলাদেশ কি একা আপনার?’ খালেদ হাসছেন। এই হাসির অর্থ আছে। এই হাসি আত্মবিশ্বাসের হাসি। এই হাসির অর্থ—এই প্রত্যয়ী জাতির যেভাবেই হোক, যত দিনেই হোক, যুদ্ধে বিজয় অনিবার্য।

মেজর খালেদ তখনই ফিল্ড টেলিফোনে ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে কথা বললেন। স্টুডেন্ট কোম্পানি এলাকায় একটি ভালো জায়গায় দুটি ১৮০ পাউন্ড টেন্ট লাগিয়ে এই ছেলেদের দিয়ে তৈরি করতে বললেন ‘ওয়াই প্লাটুন’ (Young Platoon)। ২১ পাউন্ড ওজনের ব্রিটিশ ৩০৩ ব্রাউনিং (এলএমজি) এরা তুলতে পারত না ঠিকই, তার পরও এদের অসাধ্য এমন কিছুই ছিল না। এই ছেলেদের জন্য আলাদা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো। কঠোর সে ট্রেনিং। পরিশ্রান্ত এই ছেলেদের কঠোর প্রশিক্ষণে কোনো আপত্তি নেই, ওরা বরং আগ্রহী। বুক ভরা সাহস ওদের। এ কোনো কথার কথা নয়।


লিখেছেন মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভুঁইয়া
মূল লেখা : http://bit.ly/Nprzd6


Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved