নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি (এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি)



ট্রাক্টরটা ঘটাং ঘটাং করে ছুটে চলেছে। দুপাশে বড় বড় ছাতার মত শিরিষ গাছের সারি পেছনে চলে যাচ্ছে। ছোটখাট কোন ঝাঁকিতেও পেছনের ট্রলিদুটো বেয়াড়া ভাবে দুলে উঠছে। একটানা ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কি ভেবে যেন ট্রলির কেউই কোন কথা বলছেনা। হয়ত অজানা দেশের কথা ভেবে কিংবা কি এক আশংকায় সবাই জড়সড় হয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে বসে আছে। বিকেলের ধক্কল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি বড় বাজারের চৌরাস্তায় বোমা! সে সময় খেয়াল হয়নি, এখন এই ট্রলিতে বসে হাঁটুর কাছে হাত দিতেই ব্যথা করে উঠল, হাঁটু আর কনুই ছড়ে গেছে। রক্ত জমে শুকিয়ে আছে। আমার কোন ফুলপ্যান্ট ছিলনা। হাফপ্যান্ট পরা থাকায় হাঁটু আর কনুইয়ের এই দশা। একটু যেন শীত শীত লাগছিল, অথচ তখন প্রায় গরমকাল। কোন বাস বা ট্রাক আমাদের ক্রস করে উল্টো দিকে যাচ্ছেনা। মাঝে মাঝে দুএকটা বাস বোঝাই হয়ে আমাদেরকে পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছে। একেবারে ছোট বোনটি মা’র কোলে মাথা গুঁজে শুয়ে আছে, বাকি দুই বোন মায়ের দুপাশে মা’কে জড়িয়ে বসে আছে। একটু দূরে বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন। একসময় বাবা বিড় বিড় করে বলে উঠলেন-‘এতটা বছর পর আবার পশ্চিম বঙ্গ! আবার সেই কোলকাতা’! আমি বাবার পাশে পাল্লায় হেলান দিয়ে বসা। বাবার বিড় বিড় শুনে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-‘আপনি আগেও কোলকাতা গেছেন’? বাবা কিছুক্ষণ আমাকে দেখে বললেন-‘তুই জানিস না’? ‘না’! ঠিক সেই সময় পেছন থেকে বিলকিস চাচী (এক ইপিআর নায়েকের বউ, আমাদের পাশের বাসাতেই ছিল, তিনি একাই আমাদের সঙ্গী) বলে উঠলেন-‘ভাই আমরা কি কোলকাতায় যাচ্ছি’? ‘না, আমরা যাচ্ছি মুর্শীদাবাদ’ বাবা বললেন। তারপর বাবা যেন আমাকে শোনানোর জন্য বলতে শুরু করলেন......

‘আমার আব্বাজান আলীগড় থেকে পড়াশুনা শেষ করে নিউ আলিপুরে একটা কিতাবের লাইব্রেরী দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে আব্বাজনদের জন্য কোলকাতাই কাছের শহর। খুলনা থেকে পড়তে এসে সেখানেই বাড়ি কিনে থাকতে শুরু করলেন। তারপর গেলেন আমার বড় ভাই। তিনি কোলকাতায় পড়াশুনা শেষ করে হাইকোর্টে পেশকারের চাকরি নিলেন। ভাবীকেও নিয়ে গেলেন। তারও কয়েক বছর পর আমি তোর নোয়া চাচাও কোলকাতা গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলাম। নোয়া ভাই ভাল ছাত্র ছিল, কিন্তু আমি নাটকের দলের সাথে ঘুরে বেড়াতাম বলে ম্যাট্রিকে রেজাল্ট খারাপ করলাম। তোর বড় চাচা খুব রেগে গিয়ে আমাকে বাড়ি (খুলনা) পাঠিয়ে দিল! বাড়ি ফিরে রাগে আর পড়াশুনাই করলাম না। দুই বছর পরে আবার পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম। তারপর আমাদের গ্রামে ভীষণ অভাব নেমে এলো, কারো ঘরে চাল নেই, নতুন পাকিস্তান সরকার রিলিফ দিত। আমি আর তোর সেজ চাচা লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফ আনতাম। একবার রিলিফের চাল বেঁচে দিয়ে যাত্রা দেখতে গেলে তোর দাদী ভীষণ বকাবকি করল। আমি রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে খুলনা শহরে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। তখন নতুন বাহিনী ইপিআর এ লোক ভর্তি করছিল। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। তার কয়েক বছর পর ৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তোর দাদীর পীড়াপীড়িতে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। তার পর থেকেই স্কুলের এই চাকরি.....মাঝ পথে আমি বাধা দিয়ে বললাম- ’আপনাদের কোলকাতার সেই বাড়িটা আছে’? ‘না, মিয়া ভাই ৪৭ সালের পর সেই বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে খুলনায় বসুপাড়ায় নিজের নামে বাড়ি কিনেছিলেন, কিন্তু আমাদের কারো ভাগ নেই সেই বাড়িতে.....’ কথা শেষ হওয়ার আগেই কয়েকজন মানুষ আমাদের ট্রাক্টর আটকে দিল! বাবা নেমে গেলেন (বাবার হাতে তখন একটা রাইফেল, সেটা ট্রলিতেই রেখে গেলেন)। কিছুক্ষণ পর বাবা আবার ট্রলিতে উঠলে মা জানতে চাইলেন- ‘কি হয়েছে’? ‘কিছুনা ওরা চুয়াডাঙ্গার খবরাখবর জানতে চাচ্ছিল’। তারপর আর কেউই কোন কথা বলল না। রাত ৮টা বা ৯টার দিকে আমরা মেহেরপুরে পৌঁছুলাম। এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম!

আমরা চুয়াডাঙ্গা ছাড়ার সময় যেমন সুনশান দেখেছিলাম মেহেরপুরে তার উল্টো। সারা শহরে লোকজন গিজ গিজ করছে! শহর ভর্তি লোকজন দেখে আমাদের ভয় কেটে যাচ্ছিল । বাবা বললেন-‘সব জায়গা থেকে মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে, তার মানে সব খানেই মিলিটারী ঢুকে গেছে’! ভিড় ঠেলে আমাদের ট্রাক্টর এসে থামল সরকারী স্কুলের সামনে, সেখানে আগেই শত শত মানুষ এসে উঠেছে। আমরা নেমে কোনমতে মালপত্র নিয়ে একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। বাবা আবার বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন কয়েক ঘন্টা পর। যদিও আমাদের কাছে কেরোসিনের স্টোভ ছিল, তবুও এখানে রান্না করার উপায় নেই। বাবা কিছুতেই আমাদের কাছে বসছেন না, হন্তদন্ত হয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাধ্য হয়ে আমি হোটেল থেকে খাবার আনলাম। আমরা ছিলাম বাবা সহ ৭ জন, কিন্তু ট্রলিতে মোট ২০/২৫ জন ছিল, সবার জন্যই খাবার আনতে হলো। একা পারব না বলে আমার পরের বোনটিকে সাথে নিয়ে খাবার আনলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে যে যার মত টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। জেগে রইলাম আমি আর মা। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল। মা কখনো কি এমন জায়গায় থেকেছে! আমার নিজের তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছিলনা, কারণ এর আগেও আমি বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছি! (একবার বাবার সাইকেল চুরি করে নিয়ে অনেক দেরী করে ফেরার পর বাবা মেরেছিলেন। সেই মার খেয়ে বাড়ির কাছেই একটা লাইটপোস্টের নিচে সারারাত ছিলাম। বাবা রাগ করে আনতেও যাননি!)

অনেক রাতে বাবা ফিরে আবার আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মা’কে বলে গেলেন-মেয়েদের দিকে খেয়াল রেখো। বাবা আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে একটা পুরোনো বাড়িতে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকেই আমার গা ছমছম করে উঠল! পনের-কুড়িজন মানুষ, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের কোণে গাদা করে রাখা রাইফেল, স্টেনগান আর ব্যাগ ভরা গুলি। আমাকে ঘরের কোণে বসিয়ে বাবা তাদের সাথে কি কি সব বলাবলি করে অনেক রাতে সেই স্কুলে ফিরলেন। আমরা ফিরে দেখলাম মা জেগে বসে আছেন। আমিও শুয়ে পড়লাম। মা আর বাবা বসেই থাকলেন। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। সকালে হৈহুল্লোড় চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গল। এখন আর ট্রাক্টর নেই। যে যার মত মালপত্র গুছিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরাও আমাদের মালপত্র (একটা স্যুটকেস, একটা টিনের বাক্সো আর একটা সাইড ব্যাগ এই ছিল আমাদের মালপত্র) গুছিয়ে রিক্সায় উঠলাম। শহর থেকে মাইল খানেক দূরে প্রায় শুকনো একটা নদী। তার উপর বাঁশের মাচার সাঁকো। সেই সাঁকোর উপর দিয়ে রিক্সা পার হয়ে গেল। ট্রলির কুড়ি-পঁচিশ জনের কে কোথায় গেল জানিনা, আমরা রিক্সায় যাচ্ছি সাত জন। আমরা চার ভাই-বোন, বাবা-মা আর সেই রেজাউল মামার আত্মিয়টি, যার বয়স ষোল-সতের। তার নাম খুব সম্ভবত বুড়ি।

গ্রাম্য পথ ধরে রিকসা চলছে। আমাদের সবারই মুখ বন্ধ । আমার সব চেয়ে ছোট বোনটি যে সারাক্ষণ বকবক করতো সেও কেন জানিনা একটি কথাও বলছিলনা! কয়েক ঘন্টা পর একটা সিমেন্টের ফলক দেখে বাবা রিকসা থামাতে বললেন। বাবা নেমে গেলেন। আমি কিছু না বুঝে বাবার সাথে সাথে নেমে গেলাম। ফলকটার পাশে গিয়ে বাবা বললেন-‘এটা কি চিনিস’? আমি মাথা নাড়ালাম। এর নাম ল্যান্ডমার্ক। কাছে যেয়ে দেখলাম ওটার গায়ে একটা নম্বর লেখা। বাবা বললেন-‘ সীমানা শেষ। আমরা এবার ভারতে প্রবেশ করছি’। কিছুই না, দুপাশের মাটি একই রকম, তার পরও কেমন যেন মনে হলো। একটা শিহরণ! অজানা দেশে ঢোকার শিহরণ। বাবা কি মনে করে যেন বড় একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। মা’র চোখ ছল ছল করে উঠল। বোন তিনটি কোন কিছু না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। আমার কষ্ট না আতংক হচ্ছিল তা বুঝতে পারছিলাম না। তবে ‘অন্য দেশে’ এসে গেছি মনে করে শিহরণ হচ্ছিল। আবার মনে হচ্ছিল, এখানে পাক আর্মির বোমা পড়বে না, তাই ভালও লাগছিল। বাবার রাইফেলটা রিকসার পাদানিতে শোয়ানো ছিল। ঘটাং ঘটাং শব্দ করায় হোক বা অন্য কোন কারণে হোক বাবা রাইফেলটা খাড়া করে ঘাড়ের সাথে মিশিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর একটা কার্লভার্টের নিচে নামতেই কয়েকজন লোক ছুটে এলো। তাদের একজন প্রশ্ন করল-‘আপনারা জয় বাংলার লোক’? বাবা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই আবার প্রশ্ন-‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা’? বাবা এবারো ঘাড় নাড়ালো। লোকটি আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার পাশের একজন বলল- ‘যেতে দাও এরা শরণার্থী’। বাবা বিড় বিড় করে বললেন-‘রাইফেলটা আনা ঠিক হলো না!’। কেন জানিনা বাবা মনে হয় নতুন এক ধরণের ভয়ে ভীত হলেন, কারণ এরপরই তিনি রাইফেলটা রিকসার পাদানিতে রেখে পা দিয়ে ঢেকে রাখলেন।

মেঠো পথে রিকসা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে এগিয়ে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। এই পথে যারাই আমাদের দেখছে তারাই দাঁড়িয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করছে, কেউ শুধু ওপারের ঘটনা জানতে চাইছে, কেউবা উল্টোপাল্টা প্রশ্নও করছে। আরও ঘন্টাখানেক পর আমরা যে পথে যাচ্ছিলাম সেটা সোজা চলে গেল। আর আমাদের রিকসা ডান দিকে মোড় নিয়ে আরও চিকন পথে এগুতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই দেখলাম গাছপালা দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। পথটা সোজা সেখানে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। আমাদের রিকসা গিয়ে থামল বিএসএফ ক্যাম্পের গেটে। লাল বাজার বিওপি। বাবা রিকসা থেকে নেমে গিয়ে বিএসএফ সেন্ট্রির সাথে অনেকক্ষণ কথা বলল। তারপর ফিরে এসে আমাদের সবাইকে নামিয়ে রিকসা ছেড়ে দিল। আমরা গেটের পাশে মালপত্র সমেত বসে থাকলাম। বাবা কে নিয়ে সেই বিএসএফ সেন্ট্রি ভেতরে চলে গেল। ইতিমধ্যে আমাদেরকে ঘিরে ছোটখাট একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমাদের এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। আমরা হ্যাঁ-হু করে উত্তর দিচ্ছিলাম। আরও অনেকক্ষণ পর বাবা এসে বললেন- শরণার্থীদের ঢোকার অনুমতি আছে, কিন্তু রাইফেল নিয়ে এসেছি বলে ওরা ওপর থেকে পারমিশন নিয়ে তারপর যেতে দেবে। আমি এসবের কিছুই না বুঝে পা টান টান করে মাটিতে বসে থাকলাম। একটা ব্যাপারে আমি খুব আশ্চর্য হচ্ছিলাম! আমার বোন তিনটি কেউ কোন কথা বলছেনা। এমনকি তারা কোন কিছু খেতেও চাচ্ছেনা! মা মাঝে মাঝে ব্যাগ থেকে পাউরুটি, বিস্কুট বের করে ছোট দুই বোনকে খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু বড়টি কিছুই মুখে দিচ্ছেনা। সারাক্ষণ আমার পাশে আমার হাতধরে থাকছে! কোনরকম ঘটনা ছাড়াই মুহূর্তগুলো পার হয়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ মেহেরপুরের দিক থেকে একটা জিপ ধুলো উড়িয়ে বিএসএফ ক্যাম্পের গেটে এসে থামল। ফর্সামতন এক অফিসার লাফ দিয়ে নামল। বিএসএফ সেন্ট্রি তাকে স্যালুট দিল। তিনি গটগট করে বিওপি’র ভেতরে চলে গেলেন। আমি ব্যাজ দেখে র‌্যাঙ্ক বুঝিনা, মুক্তিযোদ্ধা না ক্যাপ্টেন না মেজর তা বুঝতে পারলাম না। অফিসার বলতে আমি জানতাম মেজর আর ক্যাপ্টেন। বাবাকে দেখলাম কেমন যেন মুখ কালো করে বসে আছেন। কতক্ষণ পার হয়েছে মনে নেই এক সময় সেই অফিসার ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে উঠতে যেয়ে একবার আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর সোজা হেঁটে এলেন আমাদের দিকে। বাবা দাঁড়িয়েই ছিলেন। বাবার পাশে এসে ভাল করে দেখে বললেন-‘ আপনি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের লোক না?’ বাবা মিলিটারীদের মত স্যালুট দিয়ে বললেন-‘ইয়েস স্যার, ইনামুল হক ফ্রম চুয়াডাঙ্গা ইউনিট’। কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আমার কোনই ধারণা ছিলনা। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছি।

অফিসার বললেন-‘পালাচ্ছেন? দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন’? বাবা থতমত খেয়ে বললেন-‘না স্যার পালাচ্ছিনা, আমি আমার পরিবারকে মুর্শীদাবাদে রেখে আসতে যাচ্ছি.....’ বাবার কথা শেষ না হতেই তিনি হুকুম করলেন- ‘নো, ইউ শ্যুড ব্যাক উইথ মি’..... বাবা কাতর মিনতি করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন এই ছোট্ট একটা ছেলে কি করে সেখানে যাবে, কি ভাবে তারা অচেনা যায়গা খুঁজে পাবে, ভীন দেশ..... বাবাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আবারও হুকুম হলো। বাবা একবার পেছন ফিরে তাকালেন, মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না থামালেন, আমাদের কাছে এসে একে একে সবার মাথায় হাত দিয়ে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললেন-‘ আল্লার উপর ভরসা করে ছেড়ে দিয়ে গেলাম, যদি বেঁচে থাকি হয়ত দেখা হবে’, আমার কাছে এসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন-‘ ভয় পেয়না, তোমার উপর দায়িত্ব থাকল, নিজে বাঁচবে, মা-বোনদের বাঁচাবে.....আমার বুক ফেটে কান্না আসলেও শক্ত হয়ে থাকলাম, কিন্তু যেই বাবা ঘুরে জিপে উঠতে যাবেন আমি তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম.... বাবা এতক্ষণ নিরবে কাঁদছিলেন, এবার তিনিও আমাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে থাকলেন.....জিপটা স্টার্ট দেওয়াই ছিল, বাবা আমাকে ছাড়িয়ে জিপের পেছনে উঠে বসলেন, ধুলো উড়িয়ে জিপটা চলে গেল!

‘স্যাকরিফাইস’! ‘স্যাকরিফাইস’ কথাটি বলেলন আমার পেছনে দাঁড়ানো এক বিলাতী সাহেব। মা তিন বোনকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন..... আমি একা দাঁড়িয়ে জিপের ধুলো ওড়ানো পথের দিকে চেয়ে কাঁদছি, আমার মনে হলো আমাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আমি হাতড়ে হাতড়ে কুলে আসতে চাচ্ছি কিন্তু পারছিনা......কতক্ষণ কেঁদেছিলাম মনে নেই এক সময় দেখলাম আমার মুখের সামনে একটা লম্বা চোঙামত কি যেন ধরা, তিনজন বিলাতী সাহেব আমার মুখের সামনে ওটা ধরে রেখেছে। সেন্ট্রি জানাল তোমার কান্না রেকর্ড করছে, ওরা জার্নালিস্ট। হিচকি তুলতে তুলতে একসময় আমার কান্না থামল। মনে পড়ল বাবার শেষ কথাগুলো..... ‘ আল্লার উপর ভরসা করে ছেড়ে দিয়ে গেলাম, যদি বেঁচে থাকি হয়ত দেখা হবে, ভয় পেয়না, তোমার উপর দায়িত্ব থাকল, নিজে বাঁচবে, মা-বোনদের বাঁচাবে.....’ চোখ মুছে আমি মা’র কাছে গিয়ে বসে মা’র কান্না থামালাম। সেই বিলাতীরা তাদের ব্যাগ থেকে চকোলেট, টফি বের করে বোনদের হাতে দিল । মা ব্যাগ থেকে একটা চিরকুট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মা’র যেন আর কিছুই বলার ছিলনা। আমি কাগজটা মেলে ধরলাম, দেখতে পারছিলাম না, এতক্ষণে খেয়াল করলাম সূর্য ডুবে গেছে, চারিদিক আবার আঁধার হয়ে গেছে , কাগজটায় লেখা- মোঃ রেজাউল ইসলাম, সুন্দরপুর, কান্দি, মুর্শীদাবাদ। কাগজের টুকরোটা বুক পকেটে রেখে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল হাফপ্যান্ট হাওয়াই সার্ট স্যান্ডেল পায়ে ঘাড়ে ব্যাগ ১১ বছরের এক কিশোর! পথ চলা শুরু হলো............


মূল লেখা: http://www.somewhereinblog.net/blog/monjuraul/29053198
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved