আমরা ছুটে চলেছি অচেনা গন্তব্যে ((এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি)



কবে থেকে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল জানিনা, তবে স্কুলে যেতে হচ্ছেনা সেইটাই আমাদের মহানন্দ। শুধুই স্কুল নয়, আমাদের আরও অনেক কিছু বন্ধ হয়ে গেল। এই সময়ে অর্থাৎ বসন্তে রেল স্টেশনে দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে আখ আসত। সেই আখ মেশিনের পাল্লায় মেপে ওয়াগনে উঠে দর্শনা চিনিকলে যেত। আমাদের প্রথম টার্গেট ছিল গরুর গাড়ি! গাড়োয়ানের পেছনে বিশাল আখের বোঝা, তাই পেছনে কি হচ্ছে সে দেখতে পেতনা। আমরা টাইট করে বাঁধা আঁটি থেকে টেনে টেনে আখ বের করতাম। কখনো গরুর গাড়ির ‘অপারেশন’ ফেল মারলে চড়াও হতাম ওয়াগনে। এই কাজে আমি ছিলাম আনাড়ি। একটু বয়সে বড় গাট্টাগোট্টারা ওয়াগনে উঠে ‘মাল’ নামাত। আমরা ছোটরা দৌড়ে দৌড়ে কুড়োতাম। তারপর সেই আখ চেরানো শেষ হলে বাড়ি ফিরে ভাত খাওয়ার সময় টের পেতাম আসল জ্বলুনি! কখন যে আখের খোসায় লাগাম চিরে গেছে খেয়াল হতো না। সেবার এই অতিসাহসী অভিযানও বন্ধ হয়ে গেল! যার যার ঘরে লাটাই ঘুড্ডি ছিল তাতেও আর নতুন মাঞ্জা পড়ল না। ‘মুনা’ নামের বিখ্যাত মাঞ্জাঅলা নিকম্মা বসে থাকত দোকান খুলে।

আমি তখন ভি.জে(ভিক্টোরিয়া জুবলী) স্কুলের ছাত্র। আমাদের স্কুলটা ছিল একেবারে নদীর ধারে।স্কুল থেকেই একটা ঢাল বেয়ে নদীতে নামা যেত। বাড়ি থেকে মাইল খানেক আর স্কুলের সাথেই হওয়ার পরও আমি নদীতে নামতাম না। সাঁতার জানাই ছিল, তবুও নামা বারণ, কারণ বছর দুয়েক আগে আমার খেলার সাথী ‘আপেল’ ওই নদীতে শ্যাওলা পেঁচিয়ে আর উঠতে পারেনি! সেবারও আমরা সবাই একসাথে নাইতে নেমেছিলাম। ওকে উঠতে না দেখে আমরা বাড়িতে খবর দেওয়ার পর বিকেলের দিকে তাকে মৃত অবস্থায় তোলা হয়েছিল! আপেলের মৃত্যু আমাকে প্রথম বার গোরস্থানে নিয়েছিল। লাশ, কবর, মাটিচাপা এই বিষয়টি আমার স্মৃতিতে যোগ হলো সেবার। সেই থেকে আর নদীতে নামিনি। এই ভি.জে. স্কুলের পাশেই ছিল সরকারী হাসপাতাল (পুরোনো হাসপাতাল)। হাসপাতালের আর একটু দূরে নদীর ধারে খ্রীষ্টানদের চার্চের মত দেখতে ধূসর সাদা একটা মস্ত বাড়ি ছিল। আমরা বলতাম ‘লন্ডনের বাড়ি’। এই বাড়িটি ছিল‘হ্যাবা ডাক্তারের’(ডাক্তার আসহাবুল হক্ আওয়ামী লীগের নেতা, তবে পদবী জানতাম না)। ইপিআর ক্যাম্পের বোমা-আগুনের পর এই বাড়িটি আমাদের সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। প্রথম দিন বাবার হাত ধরে গেছিলাম। ওই বাড়িতে সারাদিন বিভিন্ন ধরণের মানুষ আসত। বুলবুল ভাই বলেছিলেন- ওরা পার্টির লোক। তখন আমার কাছে পার্টি বলতে একটিই, আওয়ামী লীগ। আমরা বলতাম ‘আম্লিগ’। শহরের কোথায় পার্টি অফিস তা জানতাম না, তবে হ্যাবা ডাক্তারের বাড়িতেই যে সব কিছু হচ্ছে সেটা বুঝতে পারতাম। মাঝে মাঝে দেখতাম অনেক ধরণের গাড়িও আসত।

শহরের অন্য কোথাও তেমন কোন আয়োজন দেখতাম না। যেহেতু স্কুল নেই তাই সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর মওকা! তবে বড়বাজার আর রেলওয়ে বাজারের কাছে যাওয়া বারণ ছিল। বাবা এবং বড়দের কাছে শুনেছিলাম ওই দুটি এলাকায় বিহারীদের বসবাস। রেলওয়ে বাজারের পেছনে একটা বিরাট দীঘি ছিল । দীঘির পাড়েই ছিল তাড়ি ভাট্টি, শুনতাম ভাট্টি চালায় বিহারীরা। সেই দীঘির পানি দিয়ে পাম্পহাউস চলত। একটানা ফটফট ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ করে পাম্প চলত। সেই পাম্পহাউস থেকে নাকি কারেন্ট হতো, আর সেই কারেন্ট দিয়ে স্টেশনে লাইট জ্বলত। আমাদের পাড়ায় কারো বাড়িতেই কারেন্ট ছিলনা। শুধু সন্ধ্যার পর বড় রাস্তায় দু’একটা বাতি জ্বলত। তাও সব রাস্তায় না, হাসপাতাল রোডে, কোর্ট এলাকায় সায়েবদের বাড়িতে আর ‘রূপছায়া’ সিনেমা হলের কাছে।

একদিন আমি আর খোকন কাউকে না জানিয়ে চলে গেলাম সেই দীঘির পেছনে। আমরা আগেও দেখেছি, তাড়ি খাওয়া মানুষগুলো চেচামেচি করত। কিন্তু এদিন দেখলাম অন্য ঘটনা! মুন্তাজ মেছুয়া(মাছ বিক্রেতা) ভরপেট তাড়ি খেয়ে বকতে লেগেছে, তাকে ঘিরে আরও কয়েকজন সমানে বকে যাচ্ছে.....‘সুমুন্দির ছেইলেদের ইবার দেইকে ছাড়ব, এই সুমুন্দিদের জন্যি রেলে চাকরি পাইনিকো, ইবার কচুকাটা কইরব’। কাকে বলা হচ্ছে, কে সুমুন্দির ছেলে সেটা বুঝতে না পেরে আর একটু কাছে যেতেই মুন্তাজ মেছুয়া আমাকে চিনতে পেরে কাছে ডাকল- ‘খুকা এইকেনে কি কচ্চ? বাড়ি যাউ, এইকেনে ঝামিলে হতি পারে’। আমরা তাড়াতাড়ি কেটে পড়লাম। সন্ধ্যার দিকে জানা গেল মুন্তাজ কে বিহারীরা কেটে ফেলেছে! এই ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন পাড়ায় বাঙালি-বিহারী কেমন যেন সুনশান! কেউ কারো সাথে মেশে না। ইকরাম নামে আমাদের এক বিহারী সাথী ছিল, ও যে বিহারী সেটা আগে বুঝতাম না, কিন্তু এইসময় সেও আর আমাদের সাথে খেলতে আসত না।

এরও দিন কয়েক পরে আমরা তিন-চার জনে তাস (সিগারেটের খালি প্যাকেট যা আমাদের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু) কুড়োতে হ্যাবা ডাক্তারের বাড়ির পেছনে গিয়েছি, কারণ ওখানে অনেক মানুষ আসত।, তাই অনেক তাসও পাওয়া যেত। তাস কুড়িয়ে আমরা ফিরে আসব এমন সময় হ্যাবা ডাক্তার আমাদের ডাক দিলেন। আমরা ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেলাম। ভয়ের কারণ হচ্ছে তাকে আমাদের মনে হতো বিরাট মানুষ। যাহোক আমরা কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। এরপর তিনি একে একে আমাদের বাসা, নাম, বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমার পালা এলে আমি বাবার নাম ইনামুল হক বলেই সাথে সাথে বললাম- ‘আমার চাচার নাম মুজিবর রহমান’। কেন বললাম জানিনা, তবে মনে হলো চাচাকে উনি চিনবেন, এবং আমাকে পিঠ থাবড়ে দেবেন (এই পিঠ থাবড়ে দেওয়ার ব্যাপারটি কি ভাবে যেন আমার ভেতর ক্রিয়া করত। পারিবারিক টানাপোড়েন আর বাধ্যবাধকতায় আমাকে মাত্র ৮ বছর বয়সে চুয়াডাঙ্গা-খুলনা, খুলনা-যশোর ট্রেনে একা যাতায়াত করতে হয়েছিল। একা একা টিকিট কেটে, কখনো বিনা টিকিটে ট্রেনে যশোর যেয়ে দাদার(বড় চাচাতো ভাই, ব্যাংকে চাকরি করতেন) কাছ থেকে বেতনের টাকা এনে চাচীকে দিতে হতো। আবার বাবার কাছ থেকে টাকা এনে মা’কে । এভাবে যাতায়াতের কারণে আত্মিয়দের মুখে শুনতাম-‘এত্তটুকুন ছেলে এতবড় কাজ করে! ও বুবু তুমার ছেলে তো লায়েক হয়ে গিয়েছে’! লায়েক মানে বুঝতাম না তবে সেটা যে প্রশংসা তা বুঝে নিজেকে বয়সের তুলনায় বড় ভাবা শুরু করেছিলাম)। হ্যাবা ডাক্তার সত্যি সত্যিই পিঠ থাবড়ে দিলেন! তারপর আমরা যে বিরাট কিছু সেটা বোঝানোর জন্যই যেন বললেন- ‘ স্কুল তো বন্ধ, সারাদিন কি কর?’ আমরা কিছুই করিনা জেনে বললেন- ‘এক কাজ করো তোমরা, সবাই মিলে আমার বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করবে, দেখবে কোন সন্দেহজনক কেউ আসে কিনা, পারবে না?’ সাথে সাথে বলে দিলাম-‘পারব’, কিন্তু সন্দেজনক মানে কি জিজ্ঞেস করতেই তিনি হেসে উঠলেন। এবার বুঝিয়ে দিলেন। আমরা ‘ঠিক বুঝেছি’ ভাব নিয়ে ফিরে এলাম।

পরদিন থেকে আমাদের অলিখিত ডিউটি হলো ‘সন্দেহজনক লোক’ খুঁজে বের করা। প্রথম দিনই আমরা দৌড়ে গিয়ে তাকে জানালাম-‘একজনকে পেয়েছি কাকা’। এই খবরটা দেওয়ার সময় আমাদের সেকি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা! কাকা লোক পাঠিয়ে ব্যাটাকে ধরে নিয়ে গেল। পরে জানা গেল সে পরিচিত এক পাগল! প্রথম দিনে অভিযানে ‘ব্যর্থ’ হওয়ায় আমরা মুশড়ে পড়লাম। এর পর কাকা যে দায়িত্ব দিলেন সেটা পেয়ে আমরা আবারও উৎফুল্ল। মল্লিক পাড়া আর জোয়ার্দার পাড়ায় যেয়ে খবর আনতে হবে। ওই দুই পাড়া ছিল ‘মুল্লা’দের পাড়া। ওরা যে মুসলিম লীগের লোক সেটা পরে বুঝেছি। সেই পাড়ায় গিয়ে আমরা উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করতাম, কিন্তু সত্যিকারের কোন খবর আনতে পারতাম না। শুধু এসে বলতাম-‘কাকা ওরা বসে বসে মিটিং করে’।

এপ্রিলের এই দিনগুলি খুব দ্রুতই যেন পার হয়ে যাচ্ছিল। একদিন শুনলাম আমাদের শহরে মিলিটারি আসছে! সারারাত সব পাড়ায় পাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে গেল! বড়রা রাতভর পাহারা দিল, কিন্তু মিলিটারি এলো না। ঢাকায় ২৫ তারিখে কি ঘটেছে সেটা আমরা প্রথম জানলাম গুড়ের ব্যাপারী সোবহানের কাছে। তার বাড়ি ছিল শহর থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে সাতগাড়িতে। সে নাকি ঢাকায় গুড়ের চালান নিয়ে যেয়ে আর ফিরতে পারেনি। তারপর তার কাছেই আমরা গোল হয়ে বসে গল্প শুনলাম! সে তার দেখা ঢাকার বর্ণনা দিল। বাবারা বা বড়রা হয়ত অন্য কোনভাবে জেনেছিল, কিন্তু আমরা সোবহান ব্যাপারীর কাছে ঢাকার কাহিনী জানার পর তাকে বীর পুরুষ মনে হতে লাগল। আরও যখন শুনলাম সে ঢাকা থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরেছে, তখন তাকে বিরাট মহাপুরুষ মনে হলো। আর এক বুড়ি ছিল খয়েরের মা। সে পার্ব্বতীপুর থেকে রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে! তার কাছে গল্প শুনলাম পার্ব্বতীপুরে কি ভাবে বিহারীরা বাঙালিদের কেটে প্লাটফর্মে বিছিয়ে রেখেছিল। বুড়ির কথায় মনে হলো ওখানে একটাও আর বাঙালি নেই, সব সাফ!

এপ্রিলের ১০ অথবা ১১ তারিখে আরও একবার যশোর থেকে প্লেন এসে চক্কর দিয়ে চলে গেল। সেদিন কোন বোমা পড়েনি। এর পর পরই বাবা বললেন-আমাদের বাসা চেঞ্জ করতে হবে। পরদিন রিকশা-ঠেলাগাড়ি করে দিনে দিনে আমাদের বাসা চেঞ্জ করা হলো। আমার চেনা পাড়া থেকে মাইল খানেক দূরে শহরের বাইরে যে নতুন সরকারী হাসপাতাল হয়েছে সেখানেই একটি ঘরে আমাদের ঠাঁই হলো,বাবা বলেছিলেন হাসপাতালে বোমা মারবে না। পাশের ঘরে উঠলেন রেজাউল মামারা। এই রেজাউল মামার আদি বাড়ি ইন্ডিয়ায়, এটা জানতাম, তবে কোথায় তা জানার দরকার হয়নি কখনো। বাসা বদলের পর মামা বলে রাখলেন – পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আমরা মুর্শীদাবাদ চলে যাব। তখনই জানলাম মামাদের বাড়ির আসল ঠিকানা। এই নতুন ঠিকানায় এসে আমার আর বাসার বাইরে যাওয়া হলো না খুব একটা। বাসায় আমার তিন বোনকে নিয়েই সময় কেটে যেতে লাগল। আমার পরের বোনটির বয়স ছিল ৮, তার ছোটির ৬ এবং সবার ছোটটির ৩/৪ বছর। মা অধিকাংশ সময় গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় অসুস্থ্য থাকতেন বলে এই বোনদের জামা কাপড় পরানো থেকে চুলও বেঁধে দিতে হতো আমাকে।

এরও তিন-চার দিন পরে বাবা চাচা আর মামা আলোচনা করে ঠিক করলেন আমরা ইন্ডিয়া চলে যাব, কারণ যে কোন দিন যশোর থেকে মিলিটারী আসবে। আমরা শুনছিলাম ইপিআর ক্যাম্পে অনেক পাঞ্জাবী মেরে ফেলার প্রতিশোধ নেবে তারা। একদিন রাতে বাবা,চাচা আর মামার আলোচনা শুনছিলাম। চাচা আমাকে সরে যেতে বললে বাবা বলেন- না থাকুক, ওদেরও সব কিছু জানা দরকার আছে। আমি অনুমতি পেয়ে হা করে তাদের কথা গিলছিলাম। সেই আলোচনার পয়েন্ট বাই পয়েন্ট মনে নেই, তবে মূল কথা ছিল তারা নিজেদের অসহায় ভাবছিলেন। ওদের কে যেন বলেছিলেন- সারা শহরে কোন প্রস্তুতি নেই, কেউ কিছুই করছে না, সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছে, ঢাকার সাথেও কোন যোগাযোগ হচ্ছেনা, শহরে একটা বড় কোন মিছিলও নেই......তখনই মনে পড়ল ইপিআর ক্যাম্পের আগুনের পর শহরে কোন মিছিল হয়নি, আমরা লিফলেট নেওয়ার জন্য মিছিলের পেছন পেছন ছুটিনি!

আরও কয়েকদিন পরে আবারও হ্যাবা ডাক্তারের বাড়ির কাছে গেছি (বাবা-চাচারা রোজই যেতেন), হঠাৎ দেখলাম ইপিআর এর একটা জিপ দাঁড়ানো। এই প্রথম ইপিআরদের জিপ ওই বাড়ির সামনে দেখলাম। আগে আসলেও আমরা দেখিনি। আমরা ভেতরে চলে গেলাম, কেননা এই বাড়িতে তখন আমাদের অবাধ যাতায়াত। বাড়ির ভেতর দিকের বারান্দায় কয়েকটা চেয়ারে বসে অনেকেই কথা বলছে। তার মধ্যে কেবল হ্যাবা ডাক্তারকেই চিনতাম, আর চিনতাম বুলবুল ভাইয়ের ফ্রেন্ড আইনুল ভাইকে। আইনুল ভাই কলেজে পড়ত। হাতে ব্যাজ বেঁধে মিছিল করত। খাকি পোশাক পরা আর একজন লোককে দেখে আমরা প্রথমে মিলিটারী মনে করেছিলাম। বেঁটে খাট মত দেখতে, কিন্তু কেমন রাগি রাগি চেহারা। উনি চলে যাবার পর জানলাম উনি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (অথবা মেজর ওসমান গনি)। পর দিন আমি একা আবার ডাক্তার কাকার বাড়ি গেলাম। আর এই দিন আমি প্রথম কোন বড় অফিসারের সাথে হ্যান্ডশেক করার সুযোগ পেলাম। ভয়ে আমার গায়ে কাটা দিচ্ছিল, আবার এক ধরণের অহংকারও হচ্ছিল-আমি কত বড় মানুষের সাথে হাত মেলাচ্ছি ভেবে। কাকা পরিচয় দিয়ে বললেন- ওরা আমার ক্ষুদে গোয়েন্দা! বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার বুকের ভেতর তখন ঢিপ ঢিপ করছে!

তার পরদিনই এপ্রিলের কত তারিখ মনে নেই দুপুরের দিকে বাবা বললেন-কাল-পরশুই পালাতে হবে, পার্টি অফিসে খবর পেলাম বিশাল বাহিনী যশোর থেকে মার্চ করবে! যদিও ইপিআর ক্যাম্পের পূর্বপাশে চুয়াডাঙ্গা-যশোর রোডে নূর নগরের কাছে ব্যারিকেড দেওয়া হলো, ইপিআররা বালির বস্তা দিয়ে তার উপর বন্দুক তাক করে বসে পড়ল। শহরের সব বড় বড় মোড়ে ইপিআর আর সাধারণ মানুষ মিলে বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানাল। কিন্তু বাবা বললেন- এসবে কিছুই আটকাবে না। আর্মিরা ট্যাঙ্ক নিয়ে আসছে, আর ইপিআরের কাছে এল এম জি! শহরে কোন পুলিশ দেখতাম না, কোথায় যেন চলে গেছে সব পুলিশ! শুধু কোর্ট পাড়ায় এসডিও বা জজদের বাড়ির সামনে কয়েকজন পুলিশ দেখতাম। আমি যখন জানলাম আমরা ইন্ডিয়া চলে যাব তখন কেন যেন মনে হলো আর যদি না ফিরি! যদি মরে যাই! তাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখনো আমি সিটে উঠে চালাতে পারিনা। কখনো তিন রডের ভেতর পা দিয়ে আবার কখনো রডে বসে হাফ-প্যাডেলে সাইকেল চালাতাম। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা শহরে যত বন্ধু বান্ধব আছে সবার বাড়ি গিয়ে বলে এলাম- ‘আমরা ইন্ডিয়া যাচ্ছি’!

পরদিন হুট করেই আমাদের নতুন বাসার সামনে একটা ট্রাকটর এসে দাঁড়াল। শুরু হয়ে গেল চার-পাঁচটি পরিবারের বাঁধাছাদা। মামা আগেই মামী বুলবুল ভাই, খোকন, খুশি, তুহিনদের ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মামার বাসায় একটি মেয়ে থাকত ১৬/১৭ বছর বয়সের, মামার মুর্শীদাবাদের আত্মিয়, সে আমাদের সাথে। মামা যাবেন না! হাসপাতালের ডাক্তার কম্পাউন্ডার কেউ যেতে পারবেন না। সারা দুপুর ধরে গোছগাছ চলল। আমি বোনদের আর আমার জামা কাপড় বাক্সে ঢোকালাম। ঘুড়ি লাটাই , লাটিম আর মার্বেল গুলো গুছিয়ে বাক্সে ঢোকানোর সময় বাবার ধমক খেয়ে ফেলে দিলাম, কিন্তু বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েকটা মার্বেল পকেটে নিলাম। মা তার এটা ওটা গোছগাছ করে সেলাই মেশিনটাও বেঁধে রাখলেন। হঠাৎ মা দেখলেন আমার পায়ে দেওয়ার স্পঞ্জ স্যান্ডেল নেই। জুতো বাক্সে নেওয়া হয়েছে কিনা তাও মনে নেই। কোন কিছু না ভেবে মা আমাকে টাকা দিয়ে বললেন- স্যান্ডেল কিনে আন। ওই তাড়াহুড়ায়ও আমি স্যান্ডেল কিনতে বড় বাজার চলে গেলাম, স্যান্ডেল কিনে কেবলই দোকান থেকে বের হয়ে বাসার দিকে হাটা দিয়েছি হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজ করে বড়বাজারের চৌরাস্তার উপর বোমা ফাটল! কে যেন আমাকে টান দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিল! আমার চোখেমুখে তখন ধুলোবালি একাকার! আমার মনে হলো আমি মনে হয় মরে গেছি! দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূণ্য হয়ে মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে, বোমায় কতজন মারা গেছে কেউ বলতে পারছে না, আহতরা কোঁকাচ্ছে, হুড়মুড় করে রিকসাগুলো এদিক-ওদিক পালাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর চৌরাস্তাটা যেন খেলার মাঠ হয়ে গেল! একটাও মানুষ নেই ! আমি পড়িমরি করে উঠেই বাসামুখো ছুট লাগালাম। কোথাও না থেমে এক দৌড়ে বাসায় ফেরার পর দেখলাম মা কাঁদছেন, আর বাবা মা’কে বকাবকি করছেন কেন আমাকে এই সময়ে বাজারে পাঠানো হলো বলে।

ট্রাক্টরের দুইটি ট্রলিতে সবাই উঠে বসে আছে, কেবল আমার জন্য অপেক্ষা। আমাকে কে যেন ট্রলিতে তুলে দিল। বাবা কয়েকজনের সাথে কথা বলছেন উত্তেজিত হয়ে। হাসপাতালের এক লোক খবর দিল বড়বাজারে বোমা(মর্টার শেল) মেরেছে পাক আর্মি। ওরা নূর নগর পর্যন্ত এসে গেছে! ইপিআর ক্যাম্প থেকে নূর নগর মাত্র দুই মাইল! সাথে সাথে আমাদের ট্রাক্টর রওনা দিল। নতুন হাসপাতাল থেকে কলেজ পার হয়ে কোর্ট বিল্ডিং পাশে ফেলে হেলেদুলে এগুতে থাকল ট্রাক্টর। মেইন রোডে উঠে যখন ডাক্তার কাকার বাড়ির পাশে এলাম বাবা লাফ দিয়ে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে বললেন-‘কেউ নেই’! আরও এগিয়ে সেই বড়বাজারের চৌরাস্তায় এসে বা দিকে মোড় নিল ট্রাক্টর। সামনে নদী। ব্রীজের উপর ওঠার পর শেষবারের মত পেছন ফিরে তাকালাম, ধুধু ফাঁকা চৌরাস্তা..... ব্রীজের ঢাল বেয়ে নেমে গেল দুই ট্রলি নিয়ে ট্রাক্টরটা.....পশ্চিমে তখন সূর্যটা ডুবছে, চারপাশ আঁধার হয়ে আসছে.....জনমানবহীন পথে ঘটাং ঘটাং করে আমরা ছুটে চলেছি অচেনা গন্তব্যে.......


মূল লেখা: http://www.somewhereinblog.net/blog/monjuraul/29052712
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved