আশ্রয়হীনের আশ্রয় খুঁজে ফেরা (এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি)



বিএসএফ সেন্ট্রি জানাল এখন আমাদের যেতে কোন বাধা নেই, সে দয়া করে কি ভাবে রিকসা পাওয়া যাবে, বাসস্ট্যান্ড কতদূরে তা জানিয়ে দেওয়ার পর আমরা সেই বাক্সো পোটরা নিয়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। কোন রিকসা নেই! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। এক সময় দেখলাম বড় বোনটি বাবার জিপ যেদিকে গেছে সেই দিকে তাকিয়ে আছে! আমি তার মুখটা ঘুরিয়ে দিতেই এই প্রথম সে কথা বলে উঠল- ‘আব্বাজী আর আসবে না’? আমি হ্যাঁ-না কিছু না বলে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। এ সময় একটি ছেলে বলল-‘সামনের মোড়ে রিকসা আছে ডেকে আনব’? মা ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘তাহলে তো খুব ভাল হয় বাবা’! ছেলেটি চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর দু’টি রিকসা এলো। আমরা লালবাজার ছেড়ে রওনা দিলাম বেতাই বাজারের দিকে। মাটির রাস্তা। দুপাশে আমাদের দেশের মতই ছোট ছোট ঘর বাড়ি । মাঝে মাঝে দু’চারটি দোকান, সেই সব দোকানে বসা মানুষগুলো রিকসা থামিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। কখনো মা কখনো আমি সংক্ষেপে যতটুকু জানি বলে যাচ্ছিলাম। আমরা যখন বেতাই বাজারে পৌঁছুলাম তখন বেশ রাত। রিকসা থেকে নেমে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় বসার পর শুরু হলো প্রশ্নবাণ! মুহূর্তেই আমাদের চারপাশে লোকজন ঘিরে ধরল। গত কয়েক দিন ধরেই শরণার্থীরা আসা শুরু করেছে, তারা একটু দূরেই একটা বটগাছের নিচে যে নতুন ক্যাম্প করা হয়েছে সেখানে আছে। কেউ কেউ আমাদেরকে সেই ক্যাম্পে চলে যেতে বলায় আমি একা ক্যাম্প দেখতে চলে গেলাম।

যা দেখলাম তাতে শিউরে উঠলাম! এখানে থাকতে হবে ভেবে অসহায় লাগল। নতুন করে কান্না উঠে এলো। মাত্র কয়েকটা তাবু টাঙ্গানো হয়েছে, সেই তাবুতে যারা উঠেছে তারা কোন রকম আছে, বাকি শত শত মানুষ খোলা আকাশের নিচে গাদাগাদি করে শুয়ে-বসে আছে! অনবরত বাচ্চাগুলো কাঁদছে! কারো সামনে মোমবাতি আবার কারো জটলার সামনে কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছে! চিৎকার কোলাহলের অনেকটাই কান্না। ছুঁটে পালিয়ে এলাম। মাকে সব বলতে মা বললেন- ‘কারো কাছ থেকে মুর্শীদাবাদ যাওয়ার পথ চিনে নে, আমরা রাতেই রওনা দেব’..... এ সময় অনেক বয়সী একজন আমাদের কাছে এসে মা’কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, মা জড়সড় হয়ে ঘোমটা টেনে দিলেন, লোকটি আরও কাছে এসে বললেন-‘মা তুমি কি ফরিদপুরের মেয়ে’? আমি আর মা দুজনেই লোকটির দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। ‘কও না মা, তুমি কি ফরিদপুরের মেয়ে’? অভয় পেয়ে মা বললেন-‘ না, আমার বাপের বাড়ি খুলনা’। ‘খুলনা কোথায়’? মা গ্রামের নাম আটলিয়া বলায় এবার বৃদ্ধ আমাদের পাশে বসে পড়লেন। ‘ মা তুমার কথা শুনেই বুজতি পারিছি তুমি আমাগে দ্যাশের মাইয়ে, আমাগে বাড়ি ছেলো মানিকদে গুপালগঞ্জ’। মা’র মুখটা দেখলাম খুশি খুশি হয়ে উঠল। আমরা ভাইবোন চুয়াডাঙ্গার (নদীয়া-শান্তিপুরের) ভায়ায় কথা বলতাম, কিন্তু মা খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। মায়ের বাপের বাড়ি খুলনা জেলায় হলেও তা গোপালগঞ্জ সীমানার কাছে। জানা গেল ওই বৃদ্ধটির বাড়ি আর আমার মামা বাড়ি কাছাকাছি, মাত্র তিন-চার মাইল দূরে। বৃদ্ধ এবার জমায়েত লোকজন সরিয়ে দিলেন। তারপর মাকে বললেন- ‘তুমাগে যাতি যদি অসুবিদে মনে করো তা’লি আমার বাড়ি থাকতি পারো, বিয়ানে না হয় চৈলে যাবা’...... নিজের চেনা ভাষায় এমন আন্তরিকতা দেখে মা একবার বললেন, ঠিক আছে সকালেই যাব, আবার কি মনে করে বললেন –‘না বাবা আমরা বরং চলেই যাই, ওরা জানে আমরা আসতিছি’, অগত্যা সেই বৃদ্ধটি কি ভাবে কোন বাসে উঠে কোথায় গিয়ে বাস বদলাতে হবে সব বলে দিলেন। আরও বললেন-‘যদি কখনো দরকার মনে করো তালি খালি আইসে বলবা নিরঞ্জনের দুকানে যাব, তালিই চিনতি অসুবিদে হবে না’।

আমরা এবার বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম, ঠিক সেই সময়ে দশ পনের জনের একটা মিছিল দৌড়ে গেল, তারা শ্লোগান দিচ্ছিল.....নকশালবাড়ি জিনাবাদ..... কমরেড চারু মজুমদার জিতে রাহে.....বলদ হলো দুধেল গাই-কংগ্রেসের ভোট নাই.....আমার কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা! এর আগে আমি আমাদের দেশে শুনেছি- জয় বাংলা....পদ্মা মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা.....শেখ শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম....এসব ভাবছি, কিন্তু হঠাৎ দেখলাম যে যেদিকে পারে হুড়মুড় করে পালাচ্ছে! পুলিশের হুইসেল, দৌড়, হুটোপুটি.....মুহূর্তে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল! আমরা ভয়ে ভয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকলাম।

সেই বৃদ্ধ যে বাসের কথা বলেছিল এক সময় সেই বাস এলো। আমরা উঠে বসলাম। বাস ছেড়ে দিল। আবারও একবার সেরকম অনুভূতি হলো যে রকম হয়েছিল চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে আসার সময়। আমরা চুপচাপ বসে আছি। বাস ছুটে চলেছে। যাত্রীদের কেউ কেউ এটা-ওটা জিজ্ঞেস করছে। আমি মুখস্থ বলে যাচ্ছি –জয় বাংলা থেকে আসছি, মুর্শীদাবাদ যাব.....ঘুটঘুটে আঁধার কেটে বাস ছুটে চলেছে, আমরা কেউ কোন কথা বলছিনা। ঘন্টা দুয়েক পর খাড়ি নদীর এপারে বাস থামার পর কন্ডাক্টর বলল আধা ঘন্টা দেরি হবে, ফেরি ওপারে। আমাদের কাছে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ছিল, মা বের করে দিয়ে পানি আনতে বললেন। আমি নেমে পাশের টিউবঅয়েল চেপে পানি আনার সময়ই প্রথম ব্যাপারটা খেয়াল করলাম! এক বয়ষ্ক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা মোছলমান? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই তিনি এক জগ পানি দিয়ে কলটা ধূয়ে নিলেন! আমি অবাক হলাম, মনে পড়ল গ্রামের বাড়িতে আমাদের নদী সাঁতরে ওপারে গুরুবরণদের বাড়িতে গেলে খুড়ি মা তাদের গ্লাসেই পানি দিতেন, রান্না ঘরে বসেই গুরুবরণ আর আমি খেতাম ! ফেরি পার হয়ে বাসটা আবার ছুটল। এবার বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগল জায়গাটা। আরও আধা ঘন্টা যাওয়ার পর বাসের কন্ডাক্টর মনে হয় আমাদের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল-‘ মাসিমা এই হলো সেই সিরাজের আম্রকানন, এখানেই স্লা মীর জাফর বেঈমানী করেচিল’ , ওর কথা শুনে বাসের যাত্রীরা কেউ ঘুরে তাকাল না, কিন্তু আমি আর মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

রাত নয়-দশটা নাগাদ আমরা পলাশী স্টেশনে পৌঁছুলাম, এবং এই প্রথম একটি জায়গা দেখে আমার খুব চেনা মনে হলো, মনে হলো আমি এখানে আগেও এসেছি! কেন এমন মনে হলো সেটা আরও পরে রেজাউল মামার কাছে শুনলাম। এই স্টেশনটা চুয়াডাঙ্গা রেল স্টেশনের মতই দেখতে। একই সময়ে বানানো বলে সব স্টেশনই একই রকম দেখতে। আমরা মালপত্র নিয়ে একটা বড় ঘরে গিয়ে বসলাম। সেখানে অনেকেই বসা। ট্রেনের এক লোককে জিজ্ঞস করে জানলাম বহরমপুর যাওয়ার ট্রেন আসবে রাত চারটায়। এই স্টেশনে এসে আর এক ব্যাপার শুরু হলো, যা আমি আগে কখনো দেখিনি, জানিনা, তাই রিতিমত ভয় পেলাম। মা’কে দেখলাম তিনি তার গহনাগাটির বাক্সটা স্যুটকেস থেকে বের করে হাতব্যাগে রাখলেন, আর সেই মেয়েটি যে আমাদের সাথে আছে, যার নাম বুড়ি, তাকে মা একেবারে নিজের কাছে টেনে বসিয়ে রাখলেন। আমরা ফ্লোরেই বসে আছি। একটা বেঞ্চে বসা দু'জন লোক আমাকে কাছে ডেকে নামধাম জিজ্ঞেস করছে, আমি আগের মতই সব বলছি, এসময় মা আমাকে চলে আসতে ইশারা করলেন। কাছে এলে মা বললেন-‘ওই মুখ কাটা লোকটার মতলব ভাল না, আর যাবি না’। এবার আমি কিছুটা ধরতে পারছিলাম। এর আগে মা কখনো বলেননি, কিন্তু এখন বললেন-‘ঘুম এলেও ঘুমাবি না, বিপদ হতে পারে!’ রাত যত বাড়ছে আমরা ততই ভয় পাচ্ছি। আমি অনেক কষ্ট করে জেগে আছি, মা’ও জেগে আছেন। বোনেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর বুড়ি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। আশপাশের কারো কোন কিছু হচ্ছেনা শুধু আমাদেরই ভয় লাগছে, এটা ভেবে আমি আরও ভয় পেলাম। গাল কাটার পাশের জন একবার বলে উঠল-‘জয় বাংলার মাল, চান্স আসুক না রগড়ে দোব মাইরি’! বার বার ওই কথাটি কানে বাজছিল-জয় বাংলার মাল!

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই, হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম! দেখি মা কাকে যেন জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন! আমিও উঠে দাঁড়ালাম- রেজাউল মামা! আমিও মামাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম! বাবা চলে যাওয়ার পর এই প্রথম দেখলাম মা’র মুখে একটু হাসি! মামা অনেকক্ষণ আমাদের জড়িয়ে থাকলেন। তার পুরু চশমা দিয়ে অনেকক্ষণ আমাকে দেখে ঘাড়ে হাত রেখে বললেন- ‘অনেক বড় হয়ে গেছিসরে বাপ! অনেক বড় হয়ে গেছিস!’ আমি আবার কেঁদে ফেললাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেই গাল কাটাকে দেখতে পেলাম না। তার পর মামা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটা নিয়ে আসলেন, আমাদের সাইকেল, তার ক্যারিয়ারে মা’য়ের সেলাই মেশিনটা। এতক্ষণে আমাদের মনে পড়ল আমরা মেশিনটা বেঁধে রাখলেও আনতে ভুলে গেছিলাম। এবার মামা গড়গড় করে বলে গেলেন.....তোরা চলে আসার পর দিন সকালেই তোদের বাসায় গিয়ে দেখি দরোজা ভাঙ্গা! ঘরে কিছুই নেই। সব লুট হয়ে গেছে। ফিরে আসার সময় হাসপাতালের এক লোক আমাকে সাইকেল আর মেশিনটা দিয়ে বলল, সে রেখে দিয়েছিল। আমি সাইকেলে করেই মেহেরপুর চলে আসি। মেহেরপুরে চুয়াডাঙ্গার পার্টির একজন বলল তোরা পার হয়ে গেছিস, তাই আমি আর দেরি না করে সাইকেল চালিয়েই রওনা দিলাম। পথে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম তোদের দেখেছে কি-না, কেউ বলতে পারল না। আসার সময় বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে অনেক শরণার্থী দেখে সেখানে খুঁজতে গিয়েই বিএসএফ এর লোকেদর কাছে সব শুনলাম। আমি মনে করেছিলাম তোরা বেতাই বাজারেই আছিস, তাই সেখানেও খুঁজেছি। তোরা যে এতদূর চলে এসেছিস.............

রাত চারটার পর ট্রেন এলো। তার আগে মামা হোটেল থেকে খাবার এনে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে খাওয়ালেন। আমরা ট্রেনে উঠে বসলাম। ট্রেন ছুটে চলল বহরমপুর। সকাল ৭ টা বা ৮টার দিকে বহরমপুরে নামলাম। আশ্চর্য! এটাও সেই চুয়াডাঙ্গা স্টেশনের মত দেখতে! রিকসায় ওঠার পর আমি হা করে দু’পাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম! এত মনুমেন্ট! এত মূর্তি!! প্রত্যেকটা মোড়ে মোড়ে গান্ধীজি, নেতাজীদের মূর্তি । মামা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন আর মাঝে মাঝে ‘হায় বহরমপুর’ বলে নিশ্বাস ছাড়ছিলেন...জানলি, এখানেই আমি স্কুল-কলেজে পড়েছি, সেসব দিনের কথা মনে পড়লে...... গঙ্গার ধারে কান্দি বাস স্ট্যান্ডে যখন নামলাম তখন সকাল নয়-দশটা মত হবে। একটা রেস্টুরেন্টে বসে আমাদের নাস্তা শেষ হলো। পরোটা আর বুন্দিয়া, সাথে আলুর দম। দিল শালপাতায় করে। হোটেলের বাইরে অনেকগুলো হনুমান বসে আছে। কেউ খাবার দিলে মানুষের মত হেঁটে এসে নিয়ে আবার আগের জায়গায় চলে যাচ্ছে। আমার বোনরা হনুমান দেখার আনন্দে দু’একটা কথা বলাবলি করল, তাছড়া ওরা সারাক্ষণই চুপ করে ছিল।

বেতাই থেকে আসার ঠিক আগে যেমন মিছিল দেখেছিলাম এখানেও তেমনি মিছিল দেখলাম। তবে এখানকার মিছিল দৌড়ে পালাল না। ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে একটা কাগজ নিয়ে এলাম। রেস্টুরেন্টের বেড়ায়, এখানে সেখানে পোস্টার লাগানো, সেই সব কথা.....নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ.....আমি ভয়ে ভয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলাম-‘মামা নকশালবাড়ি কি’? মামা তার মোটা পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে আমাকে দেখলেন, কিছুই বললেন না। ওই রেস্টুরেন্টে বসেই মা মামাকে বাবার চলে যাওয়ার কথা বললেন। মামা কি ভাবছেন তা আমি বুঝতে পারলাম না। শুধু বললেন-‘চিন্তা করিসনা, সব ঠিক হয়ে যাবে’।

আরও কিছুক্ষণ পরে আমরা কান্দি যাবার বাসে উঠলাম। এই বাসগুলো একটু বড় আর অনেক জোরে চলে। আমি জানালায় মাথা রেখে কেবলই দেখছি.....এখানকার মাটি আমাদের দেশের মত না! কেমন যেন সব লাল লাল মাটি। ঘরবাড়িগুলোও সেই লাল মাটি দিয়ে বানানো। অনেকক্ষণ গঙ্গার ধার ঘেসে যাওয়ার সময় মামা বললেন-‘এই গঙ্গাই আমাদের ওখানে পদ্মা। মামা আসার পর বাসের মানুষদের সব প্রশ্নের উত্তর মামাই দিচ্ছিলেন। দুপুর নাগাদ আমরা কান্দি পৌঁছুলাম। বাস থেকে নেমে একটা গরুর গাড়িতে চড়ানো হলো আমাদের। এখানে কোথাও মামার এক আত্মিয় আছেন তার বাড়িতে যাব। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে আবার গরুর গাড়িতে সুন্দরপুর, মামাদের বাড়ি। সেই আত্মিয়র বাড়িতে আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর মামা তার দেখা সেই ভয়াবহ কাহিনী বলতে থাকলেন........

যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্কবহর নিয়ে চুয়াডাঙ্গা আসার পথে মিলিটারীরা ঝিনেদা, মনিরামপুর, কোটচাঁদপুর, উথলী কেশবপুর সব জ্বালাতে জ্বালাতে এসেছে। আমরা যে সন্ধ্যায় শহর ছেড়েছিলাম সেই রাতেই তারা শহরে ঢুকে বাছবিচার ছাড়াই আগুন দিতে থাকে। মল্লিক পাড়ার লোকেরা বেছে বেছে সব পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বাঙালিদের বের করে এনে কাউকে ধরে নিয়ে যায়, কাউকে মেরে ফেলে। আমাদের পাড়ার লিচুবাগানে গাছের সাথে মেয়েদের বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে! কয়েকজনের স্তন কেটে নিয়েছে! যে পাড়ায় ইপিআরদের পরিবার বেশি থাকত সেই সব পাড়ায় প্রায় সব বাড়িতেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমরা যারা হাসপাতালে ছিলাম তারাই শুধু নিরাপদে ছিলাম। সারারাত আমি আহত মানুষ আসতে দেখে আর পারছিলাম না, ভোর রাতের দিকে হাসপাতাল থেকে পালালাম। বড় বাজার, রেল বাজার, মাঝার পাড়া, কোটপাড়ায় রাস্তার উপর লাশ পড়ে ছিল। কেদারগঞ্জের রাস্তা দিয়ে যারা পালাতে চাচ্ছিল দর্শনা থেকে আসা মিলিটারীদের সামনে পড়ে তারাও শেষ! একটানা অনেকক্ষণ কথা বলার পর মামা খানিক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমরা আর আশেপাশের যারা শুনছিলাম তারাও সবাই চুপ! কিছক্ষণ পর মামাই আবার মুখ খুললেন-সব চেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে কেউ কোন ভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল না! পুলিশ তো আগেই পালিয়েছে, ইপিআররাও ওরা মাইল তিনেক দূরে থাকতেই পালিয়েছে। তার পর নিজেই আবার বললেন কি আর করবে? কি-ই বা হাতিয়ার আছে ওদের! ট্যাঙ্ক কামানের সামনে রাইফেলে কি হবে! মামা হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-‘মাথামোটার কথা মনে আছে তোর’? ‘হ্যাঁ মামা আমাদের স্কুলের সামনে বাদাম বেঁচত’। মাথামোটা গুলি খেয়ে হাসপাতালে এসে মরেছে! আমি আবার শিউরে উঠলাম! মনে হলো আমার আপন ভাই বুঝি মরে গেছে! চোখের সামনে মাথামোটার চেহারা ভেসে উঠল! মাথামোটা বাদাম বেঁচে ছোট ভাইকে কলেজে পড়াত!

বিকেলের দিকে আমরা আর একটা গরুর গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম। ঘন্টাদুয়েক পরে পৌঁছুলাম ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে। নদীটা আমাদের দেশের গড়াই নদীর মত চওড়া। গাড়িটা সোজা পানিতে নেমে গেল। মামা স্থানীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন- ‘পানি কেমুন গো গাড়োয়ানের বেটা , কখুন আলছো’? গাড়োয়ান অভয় দিয়ে বলল-‘সক্কালেই তো আলছি, হাঁটুতক উঠালছে, যাওয়া যাবেখন’। গাড়ি মাঝ নদীতে যাওয়ার পর চাকা দেবে গেল বালিতে! মামা আর আমি নেমে চাকা ঠেলতে লাগলাম, এমন সময় গাড়োয়ান চিৎকার করে বলল-‘ জলদি গাড়িতে উঠেন কেনে, বান ডাকিলছে.....’ মামা গাড়িতে উঠতে পারলেও আমি পারলাম না। সাদা ফেনা তুলে একটা উঁচুমত ঢেউ এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল! উথালপাতাল খাবি খেতে খেতে আর একটা গাড়িতে আটকে গেলাম। সেই গাড়োয়ান টেনে তুলল। নদীতে পানি কম ছিল বলে বেঁচে গেলাম! চরপড়া মরা নদীতে নাকি এরকম হঠাৎ হঠাৎ ফেনা তুলে বান ডাকে!

আরও কিছুক্ষণ পরে আমরা মামাদের বাড়ি পৌঁছুলাম। মামী বুলবুল ভাই খুশি খোকনরা আমাদের জড়িয়ে ধরল। তার পর খুব নিঃশ্চিন্তে কেটে গেল কয়েকটা দিন। এই গ্রামে এক ঘরও হিন্দু নেই শুনে আমাদের কাছে নিজেদের বাড়ির মতই লাগছিল। পাড়ার শেষ দিকে রোজই গরু জবাই হয়। আমি মাংস কিনে আনি। একটা দো’তলা কোঠা বাড়ির নীচ তলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমরা আলাদা রান্না করতাম। এখানে আসার পর আমি আমার মত একটা জগতও পেয়ে গেলাম। সারাদিন ওই বাড়ির ছেলেদের সাথে নদীতে নামা, খেড়ি ক্ষেত থেকে খেড়ি চুরি করা, শাকআলু আর চিনেবাদাম তুলে আনা সবই চলছিল। আরও দশ-বার দিন পরে মামা কার কাছে যেন খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা ফিরে গেলেন। যাবার আগে চুপি চুপি মা’কে বলে গেলেন-‘আমার এখানকার ভাইয়েরা কেউই জয় বাংলা সমর্থন করে না, এরা সবাই পাকিস্তানের পক্ষে, তুই কিন্তু ভুলেও এদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলিসনি! মামা চলে যাবার পর আমরা তার নির্দেশ মতই কাজ করছিলাম। মা কিন্তু চুপি চুপি রেডিও শুনতেন। আশা ছিল যদি কখনো বাবার কোন খবর পাওয়া যায়! একদিন মামার বড় ভাই এসে মা’কে রিতিমত ধমকে গেলেন। মা নাকি মাথায় কাপড় দেয়না, হিন্দুদের মত শাড়ি পরে, সব ওয়াক্ত নামাজ পড়েনা ! একদিন পর আবার এসে বললেন- তোমরা এখানে থাকতে পারবে না!

আবারও আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়ল! কি করব এখন? মা তার একটা গহনা বিক্রি করে আমাকে টাকা দিয়ে বললেন-‘ দেখ তোর বাবাকে খুঁজে পাস কিনা’? আমি অবাক হয়ে গেলাম! বাবাকে কোথায় খুঁজব, কোথায় পাব? মামী মিনমিন করে বললেন- ‘অতটুকু ছেলে আবার বাইরে পাঠাবে’? মা কেঁদে ফেললেন। ‘কি করব ভাবী? এখানে তো থাকতে দেবেনা, তাহলে কোথায় যাব? ও যাক, দেখুক ওর বাবা যদি বেঁচে থাকে! যদি বেঁচে থাকে তাহলে নিশ্চই এপারেই আছে’। পর দিন খুব সকালে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেলাম আমি.....আবারও সেই পরিচিত দৃশ্য! মা আর দুই বোন আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে..... সবার ছোট বোনটি আমার কোলে উঠে আর নামতে চাইছে না......আমি চোখ মুছে বেরিয়ে এলাম। মাটির বড় রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকল আমার মা তিন মেয়ে নিয়ে......আমি বার বার পেছন ফিরে দেখছিলাম....একটা মোড় ঘুরে ঢালে নামার পর আর ওদের দেখা গেলনা। এদিন হেঁটেই নদী পার হলাম। আজ আর বান ডাকেনি। মনে পড়ল বাবার সেই শেষ কথাগুলো..... আল্লার উপর ভরসা করে ছেড়ে দিয়ে গেলাম, যদি বেঁচে থাকি হয়ত দেখা হবে, ভয় পেয়না, তোমার উপর দায়িত্ব থাকল, নিজে বাঁচবে, মা-বোনদের বাঁচাবে’।  


মূল লেখা: http://www.somewhereinblog.net/blog/monjuraul/29053641
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved