
ভারতের মূর্তিতে প্রশিক্ষণরত সহযোদ্ধা খোন্দকার নূরন্নবীকে কথাটি প্রায় বলতেন সামাদ। পুরো নাম আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ। ডাক নাম নিশরাত, বাসায় সবাই ডাকে তানি নামে, পুরনো বন্ধুদের কাছে আবার সেই নিশরাতই হয়ে যায় আশফি। কিন্তু মূর্তিতে পরিচিতি পায় সে সামাদ হিসেবেই। পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ
্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে। হেসেই তার কথা উড়িয়ে দিতেন নবী। কখনো বা দিতেন হালকা ধমক।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমাদের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনায় পর্যাপ্ত অফিসার না থাকায় সে সঙ্কট কাটাতে বাছাই করা ৬১ জন চৌকষ দেশপ্রেমিক সেনা নিয়ে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। দেশে চলছে মরণপন যুদ্ধ, সুদীর্ঘ ট্রেনিং এর সময় নেই, তাই মাত্র সাড়ে তিন মাসেই তাদের দেওয়া হয় দু'বছরের প্রশিক্ষণ। তাই পরিশ্রমও যেন দ্বিগুণ। নবী ভাবতেন, অতিরিক্ত পরিশ্রমেই বুঝি সামাদের এই মতি বিভ্রম।
সাথে মানসিক চাপতো রয়েছেই। এরই মধ্যে সামাদের চার ভাই এর মধ্যে তিন ভাই জড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। ছোটভাই উলফাত ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা, যাকে ধরার জন্য ইতিমধ্যে তাদের বাড়ীতে পাকবাহিনী হানা দেয় বেশ ক'বার। ছবি ছাপিয়ে দেয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন। বাবা আজিজুস সামাদকে গ্রেফতার করে চালাতে থাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন।
চারদিকে ঘন জঙ্গল,রাতে শোনা যায় বাঘের গর্জন। আছে বুনো হাতীর তান্ডব,মশা,কীটপতঙ্গ আর বিষধর সাপের উৎপাত । এরই মাঝে সামাদ, নবী, পাকিস্তানীদের থেকে পালিয়ে আসা বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালসহ এমন ৬১ জন যুবক দিনরাত লেফট রাইট করে চলছে গোপনে। লক্ষ্য তাদের সুনির্দিষ্ট- হানাদার মুক্ত বাংলা চাই। চোখে তাদের প্রতিশোধের হিংস্র আগুন। কখনো কখনো রাতে জীবন মরণ যুদ্ধ করতে হয় উন্মত্ত হাতীর পালের সাথে। এভাবেই এক সময় শেষ হয় সামাদ ও তাদের প্রশিক্ষণ। ক্যাডেট সামাদের এখনকার পরিচয় লেফট্যানেন্ট সামাদ।
যোগ দেন তিনি ৬ নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে। যুদ্ধ লে. সামাদের কাছে নতুন নয়, কারণ ২৫ মার্চের পর পরই ২য় ইস্ট-বেঙ্গল বিদ্রোহ করবার পর, সামাদ এবং ক'জন ঢাকা থেকে গিয়ে তাদের কমাণ্ডার শফিউল্লাহর সাথে দেখা করেন এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর বিপুল অস্ত্র নিয়ে ঢাকা ফিরে এসে দুই নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করতে থাকেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার কোর্সের জন্য মূর্তিতে প্রশিক্ষণে গিয়ে পুনরায় তিন মাস পর ফিরে আসেন রণাঙ্গনে। বেশ ক'দিন ৬নং সেক্টরে যুদ্ধ চালাবার পর তার বদলীর আদেশ আসে হেড-কোয়ার্টারে। কিন্তু ইতিমধ্যেই লে. সামাদ তার সহকর্মী লে. আবদুল্লাহর সাথে পরিকল্পনা করেছিলেন রায়গঞ্জ আক্রমণের। আশা ছিল, শেষ এই যুদ্ধ করে হেডকোয়ার্টারে ফিরবেন তিনি।
অবশেষে ১৯ অক্টোবর ১৯৭১ মধ্যরাতে, (ঘড়ির কাটায় ২০শে আগস্ট) লে. সামাদ এবং লে. আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দু'টো দল দুই দিক থেকে এগিয়ে যায় রায়গঞ্জে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটির দিকে। কিন্তু অল্প এগানোর পরই বুঝতে পারে সম্মুখে তাদের জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি শক্তিশালী দল।
একটি মাইন বিষ্ফোরণের শব্দে পাকিস্তানীরা সজাগ হয়ে যায় আক্রমণের এবং শুরু হয় সামাদের দলের উপর তীব্র মেশিনগ্যান ফায়ার এবং গোলাবর্ষণ। কিন্তু তবু দমে যাবার পাত্র নন সামাদ। বলতে লাগলেন, “কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচব।” কিন্তু সময়ের সাথে বাড়তে থাকে পাকিস্তানীদের আক্রমনের তীব্রতা, সেই সাথে বাড়ছে আহতদের পাল্লাও। সামাদ নির্দেশ দেন তার দলকে পিছু হঠবার। কিন্তু নিজে পড়ে রইলেন সামনে, একটি বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে হালকা মেশিনগ্যান নিয়ে কাভারিং ফায়ারের লক্ষ্যে। একই সাথে তিনি ইতিমধ্যে ওয়ারল্যেসের মাধ্যমে আর্টিলারী সহযোগীতাও চান মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে।
তার কাভারিং ফায়ারে তার দল নিরাপদে পিছিয়ে গেলেও, সামাদ পড়ে থাকে পাকিস্তানীদের সম্মুখে। একের পর এক আক্রমণ আসতে থাকে তার দিকে। এভাবেই একা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে রইলেন বিশ মিনিট। কিন্তু এক সময় একটি গোলা তার মাথায় এসে লাগলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। এই আঘাতের পরও বেঁচে ছিলেন তিনি। চীৎকার করতে থাকেন পানি, পানি বলে।
তার রানার মাহাবুব হোসেন অশ্রুসজল চোখে প্রিয় স্যারের দিকে পানির একটি পাত্র নিয়ে যেতে চাইলে গুলী লাগে তার পায়েও। মৃত্যুর পূর্বে এভাবেই পানি না পেয়ে স্বাধীনতার চেতনায় তৃষ্ণার্ত সামাদ তৃষ্ণা নিয়েই দেশের মাটিতে ঢলে পড়েন। বেঁচে যায় তার দল, কিন্তু ইতিহাস হন সামাদ। যত সহজে তিনি বলতেন 'খরচ' হয়ে যাবেন, ঠিক তত সহজেই দেশের জন্য খরচ হয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে শোকাতুর তার এই দল আবারো আক্রমণ করে দখল করে রায়গঞ্জ। তার এই বীরত্বের জন্য যুদ্ধের পর মেলে বীর উত্তম উপাধী। আর সামাদের রক্তে ভেজা রায়গঞ্জের জয়মনিরহাট বাজারটি আজ পরিচিত সামাদনগর হিসেবে।
এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৪১টি বছর। কিন্তু সেই সামাদের সহযোদ্ধা, তার মা সাদেকা সামাদ, ভাই উলফাত তারা কি আজও ভুলতে পেরেছে সামাদকে? উঁহু। আজও যখন মেজর জেনারেল খোন্দকার নূরন্নবী শোনেন সামাদের প্রিয় গানটি -
'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুব তারা
আর কতকাল আমি রব দিশেহারা'
তখনই তার চোখে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই টগবগে দেশপ্রেমিক যোদ্ধা সামাদের কথা। এই গানের মাঝেই অনন্ত আকাশের ধ্রুবতারার মতোই উজ্জ্বল হয়ে আজ সামাদ নীচে তাকিয়ে দেখছে তার প্রিয় দেশটিকে।
শ্রদ্ধা নিও হে বীর যোদ্ধা ল্যাফটেনেন্ট আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ (নিশরাত)। জেনে রেখো, এ জাতির সন্তান তোমারই পরবর্তী প্রজন্ম তোমার ত্যাগে আজ চীর কৃতজ্ঞ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমাদের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনায় পর্যাপ্ত অফিসার না থাকায় সে সঙ্কট কাটাতে বাছাই করা ৬১ জন চৌকষ দেশপ্রেমিক সেনা নিয়ে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। দেশে চলছে মরণপন যুদ্ধ, সুদীর্ঘ ট্রেনিং এর সময় নেই, তাই মাত্র সাড়ে তিন মাসেই তাদের দেওয়া হয় দু'বছরের প্রশিক্ষণ। তাই পরিশ্রমও যেন দ্বিগুণ। নবী ভাবতেন, অতিরিক্ত পরিশ্রমেই বুঝি সামাদের এই মতি বিভ্রম।
সাথে মানসিক চাপতো রয়েছেই। এরই মধ্যে সামাদের চার ভাই এর মধ্যে তিন ভাই জড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। ছোটভাই উলফাত ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা, যাকে ধরার জন্য ইতিমধ্যে তাদের বাড়ীতে পাকবাহিনী হানা দেয় বেশ ক'বার। ছবি ছাপিয়ে দেয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন। বাবা আজিজুস সামাদকে গ্রেফতার করে চালাতে থাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন।
চারদিকে ঘন জঙ্গল,রাতে শোনা যায় বাঘের গর্জন। আছে বুনো হাতীর তান্ডব,মশা,কীটপতঙ্গ আর বিষধর সাপের উৎপাত । এরই মাঝে সামাদ, নবী, পাকিস্তানীদের থেকে পালিয়ে আসা বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালসহ এমন ৬১ জন যুবক দিনরাত লেফট রাইট করে চলছে গোপনে। লক্ষ্য তাদের সুনির্দিষ্ট- হানাদার মুক্ত বাংলা চাই। চোখে তাদের প্রতিশোধের হিংস্র আগুন। কখনো কখনো রাতে জীবন মরণ যুদ্ধ করতে হয় উন্মত্ত হাতীর পালের সাথে। এভাবেই এক সময় শেষ হয় সামাদ ও তাদের প্রশিক্ষণ। ক্যাডেট সামাদের এখনকার পরিচয় লেফট্যানেন্ট সামাদ।
যোগ দেন তিনি ৬ নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে। যুদ্ধ লে. সামাদের কাছে নতুন নয়, কারণ ২৫ মার্চের পর পরই ২য় ইস্ট-বেঙ্গল বিদ্রোহ করবার পর, সামাদ এবং ক'জন ঢাকা থেকে গিয়ে তাদের কমাণ্ডার শফিউল্লাহর সাথে দেখা করেন এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর বিপুল অস্ত্র নিয়ে ঢাকা ফিরে এসে দুই নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করতে থাকেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার কোর্সের জন্য মূর্তিতে প্রশিক্ষণে গিয়ে পুনরায় তিন মাস পর ফিরে আসেন রণাঙ্গনে। বেশ ক'দিন ৬নং সেক্টরে যুদ্ধ চালাবার পর তার বদলীর আদেশ আসে হেড-কোয়ার্টারে। কিন্তু ইতিমধ্যেই লে. সামাদ তার সহকর্মী লে. আবদুল্লাহর সাথে পরিকল্পনা করেছিলেন রায়গঞ্জ আক্রমণের। আশা ছিল, শেষ এই যুদ্ধ করে হেডকোয়ার্টারে ফিরবেন তিনি।
অবশেষে ১৯ অক্টোবর ১৯৭১ মধ্যরাতে, (ঘড়ির কাটায় ২০শে আগস্ট) লে. সামাদ এবং লে. আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দু'টো দল দুই দিক থেকে এগিয়ে যায় রায়গঞ্জে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটির দিকে। কিন্তু অল্প এগানোর পরই বুঝতে পারে সম্মুখে তাদের জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি শক্তিশালী দল।
একটি মাইন বিষ্ফোরণের শব্দে পাকিস্তানীরা সজাগ হয়ে যায় আক্রমণের এবং শুরু হয় সামাদের দলের উপর তীব্র মেশিনগ্যান ফায়ার এবং গোলাবর্ষণ। কিন্তু তবু দমে যাবার পাত্র নন সামাদ। বলতে লাগলেন, “কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে একসঙ্গেই বাঁচব।” কিন্তু সময়ের সাথে বাড়তে থাকে পাকিস্তানীদের আক্রমনের তীব্রতা, সেই সাথে বাড়ছে আহতদের পাল্লাও। সামাদ নির্দেশ দেন তার দলকে পিছু হঠবার। কিন্তু নিজে পড়ে রইলেন সামনে, একটি বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে হালকা মেশিনগ্যান নিয়ে কাভারিং ফায়ারের লক্ষ্যে। একই সাথে তিনি ইতিমধ্যে ওয়ারল্যেসের মাধ্যমে আর্টিলারী সহযোগীতাও চান মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে।
তার কাভারিং ফায়ারে তার দল নিরাপদে পিছিয়ে গেলেও, সামাদ পড়ে থাকে পাকিস্তানীদের সম্মুখে। একের পর এক আক্রমণ আসতে থাকে তার দিকে। এভাবেই একা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে রইলেন বিশ মিনিট। কিন্তু এক সময় একটি গোলা তার মাথায় এসে লাগলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। এই আঘাতের পরও বেঁচে ছিলেন তিনি। চীৎকার করতে থাকেন পানি, পানি বলে।
তার রানার মাহাবুব হোসেন অশ্রুসজল চোখে প্রিয় স্যারের দিকে পানির একটি পাত্র নিয়ে যেতে চাইলে গুলী লাগে তার পায়েও। মৃত্যুর পূর্বে এভাবেই পানি না পেয়ে স্বাধীনতার চেতনায় তৃষ্ণার্ত সামাদ তৃষ্ণা নিয়েই দেশের মাটিতে ঢলে পড়েন। বেঁচে যায় তার দল, কিন্তু ইতিহাস হন সামাদ। যত সহজে তিনি বলতেন 'খরচ' হয়ে যাবেন, ঠিক তত সহজেই দেশের জন্য খরচ হয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে শোকাতুর তার এই দল আবারো আক্রমণ করে দখল করে রায়গঞ্জ। তার এই বীরত্বের জন্য যুদ্ধের পর মেলে বীর উত্তম উপাধী। আর সামাদের রক্তে ভেজা রায়গঞ্জের জয়মনিরহাট বাজারটি আজ পরিচিত সামাদনগর হিসেবে।
এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৪১টি বছর। কিন্তু সেই সামাদের সহযোদ্ধা, তার মা সাদেকা সামাদ, ভাই উলফাত তারা কি আজও ভুলতে পেরেছে সামাদকে? উঁহু। আজও যখন মেজর জেনারেল খোন্দকার নূরন্নবী শোনেন সামাদের প্রিয় গানটি -
'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুব তারা
আর কতকাল আমি রব দিশেহারা'
তখনই তার চোখে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই টগবগে দেশপ্রেমিক যোদ্ধা সামাদের কথা। এই গানের মাঝেই অনন্ত আকাশের ধ্রুবতারার মতোই উজ্জ্বল হয়ে আজ সামাদ নীচে তাকিয়ে দেখছে তার প্রিয় দেশটিকে।
শ্রদ্ধা নিও হে বীর যোদ্ধা ল্যাফটেনেন্ট আবু মঈন মো. আশফাকুস সামাদ (নিশরাত)। জেনে রেখো, এ জাতির সন্তান তোমারই পরবর্তী প্রজন্ম তোমার ত্যাগে আজ চীর কৃতজ্ঞ।
আগে প্রকাশিত : https://www.facebook.com/749.12924
Post a Comment