এক খাটোসাটো যুবক মহিউদ্দীনের গল্প
মে ১৯৭১, যশোরের কাছেই এক ইয়ুথ ক্যাম্প। ক্যাপ্টেন হাফিজের গাড়ীর সামনে, ঠিক চাকার কাছেই সটান শুয়ে আছে একটি ছেলে। হাফিজের যেতে হয় তো তবে, যেতে হবে তার গায়ের উপর দিয়েই। অদ্ভুত এই সমস্যায় পড়ে বিরক্তিতে কুঁচকে আসছে হাফিজের ভ্রুঁ। আর এই ছোটখাট একগুঁয়ে ছেলেটির নাম মহিউদ্দীন। বাবার ছিল একটি বন্দুকের দোকান যশোর শহরে, এখন নেই কিছুই।
ক্যাপ্টেন হাফিজ (মেজর পরবর্তীতে) এই ইয়ুথ ক্যাম্পে এসেছিলেন মূলত তরুণদের খোঁজে, যাদের ট্রেনিং দিয়ে প্রেরণ করা হবে মুক্তিযুদ্ধে। অন্যান্য দেশে যেখানে যুদ্ধ যাবার সৈন্যের অভাব, সেখানে একাত্তরে আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল ঠিক উলটো। কি পনের, কি পঞ্চাশ, দেশের তরে প্রাণ দেবার জন্য সকলেই এক বাক্যে রাজী যুদ্ধে যেতে।
তাই হাফিজের বাঁশী শোনা মাত্র ক্যাম্পের চারশজন দাঁড়িয়ে যায় একই লাইনে। কিন্তু এত ছেলেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানোর মত ব্যবস্থা বা অস্ত্র নেই আমাদের। তাই সবাই যে ইচ্ছে থাকলেই যুদ্ধে যোগ দিতে পারবে, তা কিন্তু নয়। আর এত আগ্রহী ছেলেদের মধ্যে থেকে বাছাই করবার জন্য আমাদের সৈনিকদের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, যাতে বাদ পড়ে যায় নব্বই ভাগ প্রার্থীই।
মুক্তিযুদ্ধ তথা নিশ্চিত মৃত্যুর পথে যোগ দেবার জন্য যারা টিকে যায় তাদের হাতে যেন ধরা দিয়ে পূর্নিমার চাঁদ। ভাবুন একবার, দেশের তরে প্রাণ বিসর্জনেও সেসময় চলছিল প্রতিযোগীতা। আর যারা ব্যর্থ হয় উচ্চতার পরীক্ষায় না টিকে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বেশীরভাগই। কিন্তু এই অসম পরীক্ষা মানতে রাজী নয় মহিউদ্দীন। তাই শুয়ে পড়ে হাফিজের গাড়ীর সামনে, তাকে না নিয়ে যেতে দেবে না কিছুতেই।
চারজন মিলে প্রচন্ড টানাটানির পর তাকে যখন বের করা হয় গাড়ীর নিচ থেকে তখন সে বলছিল, "স্যার, এভাবে উচ্চনা মেপে ভর্তি করা চলবে না। এটা দেশের স্বাধীনতার লড়াই। হাতে গ্রেনেড দিন, শত্রুর বাঙ্কার দেখিয়ে দিন, দেখুন একা গিয়ে গ্রেনেড মেরে আসতে পারি কিনা। সাহসের পরীক্ষা নিন।" আর তার এই জেদ এবং সোজা সপ্টা জবাবে তাকেই সৈনিক হিসেবে নিতে বাধ্য হন হাফিজ।
আর এই সাহসের পরীক্ষা মহিউদ্দীন ঠিকই দিয়েছিল। একের পর এক যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহন করে দেশ স্বাধীন হবার মাত্র দু'দিন আগে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সিলেটের উপকণ্ঠে পাকিস্তানীদের হাত থেকে এমসি কলেজ দখলে গিয়ে। খ্যাঁপাটে এই ছেলেটিকে খার্বাকৃতির বলে যুদ্ধে নিতে চায় নি হাফিজ, কিন্তু আকৃতি খাটো হলে কী হবে, মনন আর দেশপ্রেমের দিক থেকে মহিউদ্দীন যে ছিল হিমালয়ের চেয়ে উঁচু ছিল তা যেন সে প্রমাণ করেছে দেশের তরে রক্ত দিয়েই। এই দেশ, মহিউদ্দীনকে কি দিয়েছিল? কিছুই না, তবু মহিউদ্দীন হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়েছিল তার প্রাণ এই দেশের তরেই। আর আজ আমরা সেই মহিউদ্দীনের রক্তের উপরে দাঁড়িয়ে যখন বার বার বলে বেড়ায় কী হবে এই দেশে, কী পেলাম দেশ স্বাধীন করে তাদের কি অকৃতজ্ঞ বললে কি কম হবে?
আগে প্রকাশিত: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=3563
Post a Comment