একাত্তরের জননীরা


একাত্তরে গোলাম মুস্তফা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যুদ্ধে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের তাগিদেই। মায়ের প্রিয় ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়ও নিজ হাতে খাবার তুলে দেন মা। দেশপ্রেমের অমোঘ টানে হানাদারবধে সেই মুস্তফাই যোগ দিতে চান যুদ্ধে। শুনেই কেঁপে উঠলো মায়ের মন। তবু বাঁধা দিলেন না কিছুতেই। যাবি? যাহ, ফ
িরে আসবে বীরের বেশে।

যাবার আগে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করবার সময় মুস্তফা অনুভব করে তার মাথার চুল ভিজে যাচ্ছে মায়ের চোখ থেকে ঝরঝর করে পড়া পানিতে। আর এদিকে ছেলের চোখের পানি এসে পড়ছে মায়ের পায়ে। মা জানেনা ছেলে আর ফিরবে কিনা, পুত্র ভাবছে এটাই কি শেষ দেখা তার মমতাময়ী মায়ের সাথে? একবার কল্পনা করুনতো পুত্র আর মায়ের নিঃশব্দ এই কান্নার দৃশ্যটুকু। ভাবা যায়? এতদিন ধরে যে ছেলেকে নিজ হাতে খাইয়েছেন, স্কুলে পাঠিয়েছেন, বড় করেছেন, সেই ছেলেকেই আজ ঠেলে দিচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুর পথে?

ফেণী মুক্ত হলো ৬ই ডিসেম্বর। বিজয়ী এক বীরের বেশে ফিরে এলেন মুস্তফা মায়ের কোলে। মুস্তফা এখন আর ছোট নয়, মৃত্যু, হত্যা আর জয়ের যুদ্ধ মুস্তফাকে করেছে পরিণত।

একদিন হঠাত বাড়ীতে চালের মটকার (বড় পাত্র) ভেতর মুস্তফা আবিষ্কার করে বসলেন অদ্ভুত এক দড়ি। কিছু দূর পর পর গিট দেওয়া সে দড়িতে। টান দেওয়ার পর সে দড়ি বের হতেই থাকে, শেষ নেই তার। গিঁট দেওয়া প্যাঁচানো চিকন সেই দড়িটি মাইলখানেক তো অন্তত হবেই। অদ্ভুত এই জিনিসটি মায়ের সামনে আনতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে মা।

মা যে কিছু লুকোতে চাচ্ছে মুস্তফার তা চোখ এড়ায় না। অবেশেষে মুস্তফার চাপাচাপিত বাধ্য হয়ে মা বললেন, "বাবারে, আল্লাহর কালাম মিথ্যা হতে পারে না।" মুস্তফা যাওয়ার পর তার মা সারা রাত-দিন শুধু দুয়া পড়তেন। এক হাজারবার দুয়া সম্পন্ন হবার পর ছোট সেই দড়িতে একটি গিঁট দিতেন, আর ভাজ করে রাখা পুরো দড়িটি ছিল মাইলখহানেক লম্বা। ছেলে যাবার পর ন'মাসে মা শুধু বসে বসে ছেলের জন্য দুয়া আর ইবাদাতই করেছেন চোখের পানি ফেলে, আর কিছুই তার করা হয়নি। মায়ের ভালবাসা যে কি জিনিস, বুঝতে বাকি রইলো না মুস্তফার মোটেও।
একারণেই বোধহয় হিব্রতে বলে,"As good could not be everywhere that's why he created mother" । অর্থাৎ, স্রষ্টা সকল স্থানে তার মমতা-ভালবাসা তিনি মায়েদের সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মা যেন স্রষ্টারই যেন অংশ।

একাত্তরে বাংলার ঘরে ঘরে ঘটেছে এমনই হাজারো ঘটনা। মাতৃপ্রেম, দেশপ্রেম এসবের যে অনন্য দৃষ্টান্ত রয়েছে পুরো একাত্তর জুড়ে, তা হাজার বছরের বাঙ্গালির ইতিহাসে বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই। 

আগে প্রকাশিত: https://www.facebook.com/phot৪৫৪
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved