১৯৭১, নেত্রকোনা। দেশের মানচিত্রে এই জেলার স্থানও একেবারে পূর্ব কোণেই। এই জেলা পরিচিত মূলত হুমায়ুন আহমেদ কর্নেল তাহের ও নির্মলেন্দু গুণের জন্মস্থান হিসেবে। আরও আছেন রাসমনি হজং, কমরেড মনি সিংহ। আর হ্যাঁ, সেই সাথে আছেন মীরাশের মা, বাস নেত্রকোনার মদন উপজেলায়। এই অঞ্চলের মেয়েদের জন্মের পরই নাম রাখা হয় জজের মা, উকিলের ম
া, মাস্টারের মা এভাবে। সেই সূত্রে এই মমতাময়ীর পুরো নামই মীরাশের মা। স্বামী কামলা খাটে, আর কোলে সন্তান, একাত্তরে এই ছিল মীরাশের মা। গড়নে শক্ত-পোক্ত, সাহসে অদম্য। কেমনে যে এই মহিলা জুটে গেল ১২ জনের ছোট এক মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে তা জানা যায়নি কখনো।
তবে মীরাশের মা এবং তার এই ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধাদের দল ২৮ শে আগস্ট থেকে টানা দুদিন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যে সাহসিকতা দেখালেন তা হার মানাবে যেকোনো গল্প গাঁথাকেও। ২৮ শে আগস্ট বিকাল তিনটার দিকে অল্প শক্তির এই মুক্তিযোদ্ধা দল খবর পায় কেন্দুয়ার থেকে আসছে পাকবাহিনীর এক বিশাল দল, দলের কুদ্দুস গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসে এই খবরের সত্যতা সম্পর্কে। কি করবে এই স্বল্প শক্তির দল? পিছু হটবে? তা কি হয়?
উঁহু সকল ভয় এবং পরিসংখ্যানকে মিথ্যে করে নদীর তীর ঘেঁষেই অবস্থান নেই এই দল। আর যখনই তিনটি বড় নৌকোতে করে পাকবাহিনী মাঝ নদীতে আসে তখনই তা পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু গুলি এবং অভেদ্য লক্ষ্যের স্বীকার। দুটো নৌকা ডুবে যায় প্রথমেই, নদীতে লাফ দেয় তৃতীয় নৌকার অনেকে। জীবনে কখনো পুকুর-নদী না দেখা ও সাঁতার না জানা পাঞ্জাবীদের সেখানেও বিপদ। ডুবে মরতে থাকে একে একে। হানাদারদের রক্তে লাল হতে থাকে মগরা নদী।
অপর পাড়ে থাকা এবং আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া বাকীরা নদী পার হবার চেষ্টা বাদ দিয়ে এরপর নদীর অপর পারে এক স্কুলের মাঠে গা এলিয়ে দেয় বিশ্রাম নেবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদের এই সাহসী যোদ্ধাদের একটি দল নদী পেড়িয়ে তাদের অবস্থা দেখতে গিয়ে যখনই বুঝতে পারে পাকবাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় স্কুল মাঠে আছে, তখনই তারা আবার আক্রমণ চালায় পাকবাহিনীর উপর এবং আবারো তীব্র ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা। পালিয়ে বাঁচে অনেক স্কুলের ভেতরে গিয়ে।
এভাবেই চলে দীর্ঘ দুদিনের ভয়াবহ মদন যুদ্ধ। একটানা লড়ে চলে মীরাশের মা, এখলাস, কুদ্দুস এবং আলী আকবররা। জান দেব, তবু মাটি ছাড়বো না। এমনই ছিল তাদের দুর্দমনীয় মনোভাব। মীরাশের মা ও তার এই ছোট দলের কাছে পাকবাহিনী এত ক্ষতির সম্মুখীন হয় যে পরদিন তারা হেলিকপ্টার নিয়ে এসে আক্রমণ চালায় এই দলটির উপর, সেই সাথে তুলে নিয়ে যায় আহতদের। কখনো বুঝতেও পারেনি তারা এত ছোট একটি দলের বিরুদ্ধে লড়ছে তারা।
এই ছিল আমাদের যোদ্ধাদের দেশপ্রেম। বারবারই তারা প্রমাণ করেছে, উন্নত অস্ত্র বা প্রশিক্ষণ নয়, অস্ত্রের পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির সাহস এবং দেশপ্রেমের উপরই নির্ভর করে যুদ্ধের ফলাফল। যুদ্ধের পর এই এলাকায় পাকিস্তানীদের ৪১টি কবর পাওয়া যায় এবং মানুষ এতই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল পাকিস্তানীদের যে, তারা পরবর্তীতে কবর থেকে এই লাশগুলো তুলে নদীতে ফেলে। স্বাধীন বাংলায় নেই, পাকিস্তানীদের ঠাঁই।
কিন্তু সেদিনের সেই মীরাশের মা? যুদ্ধ খেয়েছে তার স্বামী সন্তানকে। ভিটেটাও বিক্রি করে হয়েছে নিঃস্ব। এখন মরমী ফকির, আসে নেত্রকোনায় মাঝে মধ্যে। বেঁচে আছে হয়তো কারো দয়া দাক্ষিণ্যে। স্বাধীন দেশে ঠায় হয়না মীরাশের মায়েদের, কিন্তু রাজাকারদের গাড়ীতে - বাড়ীতে উড়ে ঠিকই দেশের পতাকা। খালেদ বলতেন, স্বাধীন দেশ জীবিত যোদ্ধাদের চায় না - আসলেই কি তাই? যেদেশ তার বীরদের ছুঁড়ে দেয় আস্তাকূঁড়ে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের বারবার বসায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় সেদেশের ভাগ্যে কি কখনো ভাল কিছু রাখবেন স্রষ্টা?
---------
ছবিঃ আনন্দবাজার
তথ্যসূত্রঃ জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা (মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া)
তবে মীরাশের মা এবং তার এই ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধাদের দল ২৮ শে আগস্ট থেকে টানা দুদিন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যে সাহসিকতা দেখালেন তা হার মানাবে যেকোনো গল্প গাঁথাকেও। ২৮ শে আগস্ট বিকাল তিনটার দিকে অল্প শক্তির এই মুক্তিযোদ্ধা দল খবর পায় কেন্দুয়ার থেকে আসছে পাকবাহিনীর এক বিশাল দল, দলের কুদ্দুস গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসে এই খবরের সত্যতা সম্পর্কে। কি করবে এই স্বল্প শক্তির দল? পিছু হটবে? তা কি হয়?
উঁহু সকল ভয় এবং পরিসংখ্যানকে মিথ্যে করে নদীর তীর ঘেঁষেই অবস্থান নেই এই দল। আর যখনই তিনটি বড় নৌকোতে করে পাকবাহিনী মাঝ নদীতে আসে তখনই তা পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু গুলি এবং অভেদ্য লক্ষ্যের স্বীকার। দুটো নৌকা ডুবে যায় প্রথমেই, নদীতে লাফ দেয় তৃতীয় নৌকার অনেকে। জীবনে কখনো পুকুর-নদী না দেখা ও সাঁতার না জানা পাঞ্জাবীদের সেখানেও বিপদ। ডুবে মরতে থাকে একে একে। হানাদারদের রক্তে লাল হতে থাকে মগরা নদী।
অপর পাড়ে থাকা এবং আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া বাকীরা নদী পার হবার চেষ্টা বাদ দিয়ে এরপর নদীর অপর পারে এক স্কুলের মাঠে গা এলিয়ে দেয় বিশ্রাম নেবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদের এই সাহসী যোদ্ধাদের একটি দল নদী পেড়িয়ে তাদের অবস্থা দেখতে গিয়ে যখনই বুঝতে পারে পাকবাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় স্কুল মাঠে আছে, তখনই তারা আবার আক্রমণ চালায় পাকবাহিনীর উপর এবং আবারো তীব্র ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা। পালিয়ে বাঁচে অনেক স্কুলের ভেতরে গিয়ে।
এভাবেই চলে দীর্ঘ দুদিনের ভয়াবহ মদন যুদ্ধ। একটানা লড়ে চলে মীরাশের মা, এখলাস, কুদ্দুস এবং আলী আকবররা। জান দেব, তবু মাটি ছাড়বো না। এমনই ছিল তাদের দুর্দমনীয় মনোভাব। মীরাশের মা ও তার এই ছোট দলের কাছে পাকবাহিনী এত ক্ষতির সম্মুখীন হয় যে পরদিন তারা হেলিকপ্টার নিয়ে এসে আক্রমণ চালায় এই দলটির উপর, সেই সাথে তুলে নিয়ে যায় আহতদের। কখনো বুঝতেও পারেনি তারা এত ছোট একটি দলের বিরুদ্ধে লড়ছে তারা।
এই ছিল আমাদের যোদ্ধাদের দেশপ্রেম। বারবারই তারা প্রমাণ করেছে, উন্নত অস্ত্র বা প্রশিক্ষণ নয়, অস্ত্রের পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির সাহস এবং দেশপ্রেমের উপরই নির্ভর করে যুদ্ধের ফলাফল। যুদ্ধের পর এই এলাকায় পাকিস্তানীদের ৪১টি কবর পাওয়া যায় এবং মানুষ এতই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল পাকিস্তানীদের যে, তারা পরবর্তীতে কবর থেকে এই লাশগুলো তুলে নদীতে ফেলে। স্বাধীন বাংলায় নেই, পাকিস্তানীদের ঠাঁই।
কিন্তু সেদিনের সেই মীরাশের মা? যুদ্ধ খেয়েছে তার স্বামী সন্তানকে। ভিটেটাও বিক্রি করে হয়েছে নিঃস্ব। এখন মরমী ফকির, আসে নেত্রকোনায় মাঝে মধ্যে। বেঁচে আছে হয়তো কারো দয়া দাক্ষিণ্যে। স্বাধীন দেশে ঠায় হয়না মীরাশের মায়েদের, কিন্তু রাজাকারদের গাড়ীতে - বাড়ীতে উড়ে ঠিকই দেশের পতাকা। খালেদ বলতেন, স্বাধীন দেশ জীবিত যোদ্ধাদের চায় না - আসলেই কি তাই? যেদেশ তার বীরদের ছুঁড়ে দেয় আস্তাকূঁড়ে, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের বারবার বসায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় সেদেশের ভাগ্যে কি কখনো ভাল কিছু রাখবেন স্রষ্টা?
---------
ছবিঃ আনন্দবাজার
তথ্যসূত্রঃ জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা (মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া)
আগে প্রকাশিত: https://ঋউইআ
Post a Comment