আল্লারাখা তোমায় ভুলিনি বন্ধু!! (এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি)



গত বছর আগস্টের দিকে বন্ধু ফারুক ওয়াসিফ বলেছিল। তার পর একরামুল হক শামীম সামহোয়ারইনে"আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস" নামে একটা পোস্ট দিয়ে আমাকে ঋণী করে দিল। এর পর মানবী, রাগ ইমন বিভিন্ন সময়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন। আমি পারিনি। সময় পাইনি তেমন নয়, তবে কেন যেন মনে হয়েছে এত বছর আগেকার সব কিছু কি মনে করতে পারব? কিছু কিছু প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতিরা কি ধরা দেবে! শেষমেশ অমি রহমান পিয়ালকে কিছুদিন আগে কথা দিয়েছিলাম-ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে লিখব। হ্যাঁ, এই সেই ডিসেম্বর। একটু একটু শীতের আমেজ আর মিঠে সোনা রোদে ঝলমল ডিসেম্বর। অথচ যে ডিসেম্বরের কথা বলতে যাচ্ছি তা মোটেই আলো ঝলমল সোনা রোদের মৌতাতের সকাল ছিলনা। এক একটা প্রহর কেটেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। আমার ছেলেখেলা করা শৈশব এক হ্যাঁচকা টানে সরে গিয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল যুদ্ধের দগদগে ঘা মাখা এক কদাকার বিভৎস স্মৃতি, যা আনন্দ বেদনা আর গৌরবের এক রক্ত তিলক।

মার্চ,১৯৭১। চুয়াডাঙ্গা। ব্রডগেজ রেল লাইনটা যেখানে দিগন্তে মিশে গেছে, যখন আর দু’টি লাইন আলাদা দেখা যায়না ঠিক সেখানে রোজকার মত সূর্য উঠত। চকচকে রেল লাইনে সেই রোদের বিচ্ছুরণ। অন্য পাঁচ-দশটি দিনের মত আমাদের দিনগুলি শুরু হতো। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে নাকেমুখে দুটো গিলেই হারিয়ে যেতাম নিজেদের বানানো জগতে। ঈদগাহ মাঠের ধারের লিচু বাগানে কাদামাটি মেখে রোজকার রুটিনমত হাজির হতাম রেল লাইনের ওপারে সরকারী খামারে। আমরা বলতাম-‘ফার্ম’। বিষয়টা যে চৌর্যবৃত্তি তা বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝিনি। ফার্মে পেঁকে থাকা টোম্যাটো-গাজর মনে হতো আমাদেরই সম্পদ! পটাপট দুই-তিন সের টোম্যাটো তুলে সাথে নেওয়া গামলায় মাখানো হতো। পকেটে থাকত শুকনো মরিচ পোড়া আর লবন। চার-পাঁচ জনে মিলে সেই স্যালাড সাবাড় করে ফার্মের সেচের পানি যেখানে গিয়ে জমত সেই বিরাট চৌবাচ্চায় আমারা গোসল সেরে বাড়ি ফিরতাম। কোন ঝুটঝামেলা নেই। বিকেলে সেই ফার্ম পেছনে ফেলে আর একটু দূরে ইপিআর ক্যাম্পে যাওয়াটাও রোজকার রুটিন ছিল। ইপিআররা ফুটবল,ভলি,ব্যাডমিন্টন যা-ই খেলুক আমরা বল কুড়িয়ে আনা স্বঘোষিত ‘বলবয়’। আমার ন’য়া চাচা ছিলেন ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বৈমানিক। অবসরের পর ইপিআর ক্যাম্পে কি যেন এক দায়িত্বে কাজ করতেন। সেই সুবাদে হোক বা পড়শি হিসেবেই হোক ইপিআর ক্যাম্পে আমাদের যাতায়াত অবাধ ছিল। প্রায় সকলেই চিনত। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে ঝড় শুরু হলে ক্যাম্পের আমগাছের আমে আমাদের অধিকার ছিল নিরঙ্কুশ।

আমি বরাবরই পোশাক-আশাকে একটু ছিমছাম ছিলাম বলে অথবা কি কারণে যেন পাঞ্জাবী আর বেলুচিরা আমাকে বলত-‘তুম হামারা বেটা, তুম বাঙ্গাল য্যায়সা নেহি’! হয়ত ফর্সা মুখে বড় বড় চোখের কারণেও হতে পারে। কে.ডি.খান নামের পাঞ্জাবী অফিসারের সখ ছিল পাখি পোষা। তার রুমের বাইরে অনেকগুলো খাঁচা ভর্তি থাকত পাখিতে। আমরা হা করে পাখি দেখতাম, কারণ গুলতি দিয়ে আমরা কেউ কখনো কোন পাখি মারতে পারিনি। কে.ডি.খানের পর আর একজন আল্লারাখা আমাদের ভাল বাসতেন। তার ছেলের বয়সও ছিল আমাদেরই মত। তার ছবি দেখাতেন। কাবলি ড্রেস পরা একটি ফোকলা দাঁতের ছেলে পাহাড়ের খাঁজে দাঁড়িয়ে ছবি উঠেছে। প্রায় রোজই ওদের গেমস শেষ হলে আল্লারাখা আমদের পেস্তা বাদাম আর আখরোট দিতেন। এই রুটিনটা মার্চের শেষ দিকে এসে কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। আমরা বুঝিনা কেন কি হচ্ছে। শুধু দেখতাম সারা ক্যাম্পে ফিসফাস গুঞ্জন। আমাদের বাড়িতে একটা ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিও ছিল। সন্ধ্যায় সেই রেডিওতে বাবা-মাকে দেখতাম খুব মনযোগ দিয়ে খবর শুনছেন। তখনো খবরের কাগজ কি জিনিস তা আমরা জানতাম না। তবে রেডিও শুনে শুনে একটা গান আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছিল...

“আমাদের বন্দী করে ওরা যদি ভাবে,
দুনিয়ায় পাপের ভারে পূণ্য ডুবে যাবে,
ভুল ভুল সে যে বড় ভুল,
আমাদের সন্তানেরা দেবে সে ভুল ভেঙ্গে দেবে”।

মার্চের ২৬ বা ২৭ ঠিক মনে নেই আমাদের বাড়ির পাশে দেখলাম বড়রা বাঙ্কার খুঁড়ছে। আমরা মহাধুমধামে এই নতুন ব্যাপারটায় সামিল হলাম। কি যেন একটা হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি তা জানতাম না। আমাদের যাদের বয়স নয়-দশ-এগার তাদের পই পই করে বলে দেওয়া হলো, সাইরেণ বাজার সাথে সাথে যে যেখানেই থাকো সোজা এই বাঙ্কারে ঢুকে যাবে। সাইরেণ ছাড়াই আমরা বাঙ্কারে ঢোকা প্রাকটিস করে ফেললাম। আমাদের এই বাঙ্কার বাঙ্কার খেলাটা একদিন হঠাৎ বাস্তব হয়ে গেল! ২৮ বা ২৯, কিংবা ৩০ তারিখে বিকেলের দিকে প্রচন্ড শব্দ করে দুইটা যুদ্ধ বিমান আমাদের শহরে উড়ে এলো। এর আগে আমি কখনো যুদ্ধ বিমান দেখিনি। ট্রেনিং মত দৌড়ে সবাই বাঙ্কারে গিয়ে ঢুকলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি আর বুলবুল ভাই(আমার ধর্মমামা রেজাউল সাহেবের বড় ছেলে) বাঙ্কারের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি.....হঠাৎ মনে হলো একেবারে আমাদের পাড়ার উপর দিয়ে ও দুটো উড়ে গেল! সাথে সাথে কানে আঙ্গুল দেওয়ার পরও মনে হলো কান ফেটে যাবে, কিছুক্ষণ পর আবার, এভাবে কিছুক্ষণ পর পরই গোঁ গোঁ করে ছুটে আসছিল প্লেন দুটো। একাবার দেখলাম একটা প্লেন গোত্তা খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, বুলবুল ভাই লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করতে লাগলেন- একটা পড়েছে একটা পড়েছে! তার মানে ইপিআর রা একটাকে গুলি করে ফেলেছে! আমরা আবেগে আনন্দে লাফালাফি করতে লাগলাম, হঠাৎ দেখি সেই প্লেনটা আবার উড়ে আসছে.....রেজাউল মামা বললেন-ওটা পড়েনি, ডাইভ দিয়ে নিচে নেমেছিল। এর কিছুক্ষণ পর দেখলাম ইপিআর ক্যাম্প থেকে কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া আকাশে উঠে যাচ্ছে.... ‘ওরা ক্যাম্প গুড়িয়ে দিয়েছে’, কথাটা শোনার পর আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করলাম। কতক্ষণ মনে নেই, এক সময় এয়ার এ্যাটাক শেষ হলো। আমরা কোন কিছু না ভেবেই দৌড় দিলাম। গন্তব্য ইপিআর ক্যাম্প।

তখনো দাউ দাউ করে আগুণ জ্বলছে। চারিদিকে সৈন্যরা ছুটোছুটি করছে। অনেকক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে আগুন দেখলাম। আমাদের কিছু করার ছিলনা। শুধুই আতঙ্কে গলা শুকয়ে আসছিল। আগুণ একটু থামার পর আমরা ক্যাম্পের ভেতরে যাচ্ছি, সেলুনের পাশে ইপিআরদের গরু রাখার জন্য বড়মত একটা চাতাল ছিল, মোটা লোহার শিক দেওয়া। সেটার পাশ দিয়ে যাবার সময় কে যেন আমার নাম ধরে ডাক দিল! আমি চমকে ফিরে তাকালাম, কাউকে দেখলাম না। আবার সেই ডাক! এবার শিকের কাছে গিয়ে দেখি আল্লারাখা! পাশে কে.ডি. খান এবং আরো অনেক পাঞ্জাবী সৈন্য আর অফিসার। আল্লারাখা কি যেন বলতে চাচ্ছিল, একজন বাঙালি সৈন্য আমাদের টেনে সরিয়ে নিয়ে এলো। ধমক দিয়ে বলল-আর কখনো ওদের কাছে যাবেনা, ওরা পাকিস্তানী কুত্তা। বাড়ি ফিরেও মনের ভেতরকার দ্বন্দ্ব দূর হচ্ছিল না। বুঝতে পারছি পাকিস্তানী আর্মিরা আমাদের মারতে চাইছে, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফাইটার প্লেন এসে বোম্বিং করে ক্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার বাবা অনেকগুলো মানুষের সাথে কোথায় যেন বেরিয়ে সেই অনেক রাতে বাড়ি ফিরছে। যুদ্ধ লাগবে, বর্ডার খুলে দেবে, আমরা যুদ্ধে নেমে গেছি, এই সব কথাবার্তা শুনতাম, কিন্তু তার সাথে আল্লারাখার সম্পর্ক কি তা বুঝে উঠতে পারলাম না। আল্লারাখাকে কেন বন্দী করেছে তাও বুঝলাম না! তাকে আমার কখনোই আমাদের শত্রুপক্ষ মনে হয়নি। রাতে মা’কে সব বলার পর মা বাবাকে বললেন। বাবা বোঝালেন অনেক কিছু, যা আমার মাথায় ঢুকে আরো গোলমাল করে দিল। আমার চাচা বাবাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। চাচা ঐ দিনের পর ক্যাম্পে যেতে নিষেধ করে দিলেন। কিন্তু আমার ভেতর তখন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই বুঝতে পারছিনা যারা কয়েকদিন আগেও একসাথে হাসত-খেলত তারা কেন একে অপরের ‘শত্রু’ হয়ে যাবে?

পর দিন কাউকে কিছু না বলে একাই ইপিআর ক্যাম্পে গেলাম। আজ দেখলাম আল্লারাখাদের সাথে আরো অনেককেই আটকে রাখা হয়েছে। আমি একটু কাছে যেতেই আল্লারাখা শিকের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল- ‘বেটা তুমি আমাকে একটা ডাব খাওয়াতে পারবে?’ এটা শুনে কে যেন বলল-‘ ওকে বিপদে ফেলছ কেন, না বেটা তুমি যাও, আর এসো না’। রাতে আমি মা’কে সব বললাম। মা আমাকে চার আনা বের করে দিয়ে বলল-‘ওদেরকে মেরে ফেলা হবে, তোর বাবার কাছে শুনলাম, তুই কাল ওকে একটা ডাব দিয়ে আসিস’। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। মনে পড়ল আল্লারাখা ২৫ মার্চের আগেই পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের পক্ষে কথা বলত বলে পাঞ্জাবীরাও তাকে গালাগালি করত। বাঙালি সৈন্যরা আল্লারাখাকে ‘গেরাই’ (নিজ দেশের লোক) বলত। ২৫ তারিখের পর পাঞ্জাবীদের অস্ত্র সিজ করে নেওয়ার সময় সেও বাঙালিদের সাথে ছিল,সেও জয় বাংলা বলে ভলিবল সার্ভ করত!

পর দিন খুব সকালে উঠে একটা ডাব কিনে হাটা দিলাম। ক্যাম্পের কাছে এসে ডাবটা আমার গেঞ্জির তলায় লুকিয়ে নিলাম, কিন্তু গেঞ্জির তলে যে অত বড় একটা ডাব লুকিয়ে নেওয়া যায়না সেটা মাথায় আসেনি। আল্লারাখার ঘরের কাছে আসতেই বাঙালি এক সৈন্য ডাবটা কেড়ে নিল! তার পর সে কি কি বলল তা আমার মাথায় ঢুকল না। আমি অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে আল্লারাখার দিকে চেয়ে থাকলাম। আল্লারাখা একটু হেসে বলল-‘ বেটা তুম তো বহোৎ জখম উঠায়া, কোয়ি জরুরৎ নেহি বেটা, খারিয়াত র‌্যাহনা, উয়ো লোগ মানতি নেহি ম্যায় তুমহারা আদমী হু...... আরো কি কি যেন বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু কে যেন আমার হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে গেল।

তিন চার দিন আর ক্যাম্পে যাইনি, একদিন কে যেন বলল- পাঞ্জাবীগুলোকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। কোন কিছু না ভেবেই আমি দৌড় দিলাম। খেলার মাঠে সারি সারি লাশগুলো পড়ে ছিল। এদিন আমার বাবাকেও দেখলাম ওখানে। বাবা কাছে এসে বোঝালেন- ওরাও আমাদের শত শত ভাইকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে মেরে রেখেছে। আমি কিছুই শুনছিলাম না। চোখ জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছিল কাকে যেন। এক সময় পেলাম! আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে আল্লারাখা, আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ।


মূল লেখা: http://www.somewhereinblog.net/blog/monjuraul/29052206
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved