মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র

উনিশ শো একাত্তর সালে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ যে বাঙালির সমগ্র জনজীবনে গভীর ছাপ রেখে যাবে সে-কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গত কারণেই বাঙালির জাতীয় জীবনে সৃষ্টিশীলতার আবেগমাত্রই মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার অভিঘাতে হয়েছে প্রবল ভাবে উজ্জীবিত। সৃষ্টিশীল গ্রিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর দিতে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, ছবিগুলো নির্মিত হয়েছিল প্রধানত মধ্যবিত্ত জীবনের দৃষ্টিক
োণ থেকে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বাস করলেও এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষার কারণ ও প্রেরণার সূত্র থাকলেও তার যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নেই। শিল্পমাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্রের ওপরও এর প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত। সুতরাং স্বাধীনতার অব্যবহিত উত্তর কালে বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রে যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়বে এই আশা ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিধ্বস্ত দেশের বিঘ্নিত অর্থনীতির কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত উত্তরকালে অর্থ বিনিয়োগ ছিল দুরূহ। কারণ বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত না আসবার নানা বাস্তব প্রতিকূলতা ছিল প্রবল। তা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল।

একাত্তরে, সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালে নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের গণহত্যা ও মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার লক্ষ্যে কয়েকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিল। এর মধ্যে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড বক্তব্যের ও উদ্দেশ্যের প্রয়োজন মিটিয়েও পেরেছিল গভীর শৈল্পিক আবেদন রাখতে। চলচ্চিত্রের যে স্বতন্ত্র এক শৈল্পিক ভাষা রয়েছে, ধ্বনি ও ইমেজের পরিবেশনার এক স্বতন্ত্র শৈল্পিক ক্ষমতা রয়েছে এর পরিচয় আমরা স্টপ জেনোসাইড চলচ্চিত্রে পাই। মোটকথা স্টপ জেনোসাইড-এ জহির রায়হানের শিল্পীসত্তা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীসত্তার সঙ্গে মিলেমিশে স্বতন্ত্র এক স্তরে উন্নীত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে শিল্পগত সাফল্যের দিক থেকে এই চলচ্চিত্রটিকে শীর্ষে স্থান দিলে সম্ভবত ভুল হবে না। অবশ্য উনিশ শো একাত্তরের আগে, দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে জহির রায়হান নির্মিত জীবন থেকে নেয়াকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের সৃষ্টিশীল আবেগের পূর্বকথা হিসাবে ধরে নিতে পারি। এই চলচ্চিত্রেই স্বৈরাচার বিরোধিতার এক প্রতীকী রূপ দেখতে পাই আমরা। দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ এবং প্রতীকী উপস্থাপনাও পাই। মোটকথা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সূত্রগুলোকে স্পষ্টভাবে ভাষা পেতে দেখি এই চলচ্চিত্রে।

যুদ্ধশেষে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যে চলচ্চিত্র কর্মীরা মাঠে নেমেছিলেন তার পরিচয় মেলে ঢাকায় নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা থেকেই। ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ৩৩টি, ১৯৭০ সালে সেটা বেড়ে হয়েছিল ৪১টি, যুদ্ধের আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছাড়া ১৯৭১-এ আর কোনও ছবি নির্মাণ সম্ভব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যুদ্ধের আগের নির্মীয়মান ছবিসহ ৭২ সালেই ২৯টি ছবির মুক্তি পাওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই উদ্দীপিত চলচ্চিত্র-সমাজেরই পরিচয় পাওয়া যায়। যুদ্ধশেষের স্বল্প সময় পরিসরে, ১৯৭২ সালের মধ্যেই সম্পন্ন হল চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ওরা এগারো জন, মমতাজ আলী পরিচালিত রক্তাক্ত বাংলা, ফখরুল আলম পরিচালিত জয়বাংলা, আনন্দ পরিচালিত বাঘা বাঙ্গালী এবং সুভাষ দত্ত পরিচালিত অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী। চাষী নজরুল ইসলামের ওরা এগারো জন ব্যবসায়ও বিপুল সাফল্য এনে দিয়েছিল। তুলনায় অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী শৈল্পিক আকাঙ্ক্ষায় ছিল অনেক বেশি আন্তরিক। মধ্যবিত্তের উন্মূল মানসিকতা মুক্তিযুদ্ধের রূঢ় বাস্তবতাকে কীভাবে গ্রহণ করেছিল তার পরিচয় এই ছবিটিতে ফুটে উঠেছে। সদ্য বিগত যুদ্ধের আবেগঘন স্মৃতির প্রভাবে প্রায় প্রতিটি ছবিতেই ছিল কাঁচা আবেগের প্রাবল্য। মনে করা হয়েছিল আবেগের প্রবলতা হয়তো বেশি সংখ্যায় দর্শককে সিনেমা হলে টানবে।

পরের বছর, ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়েছিল আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ, নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল, আলমগীর কুমকুমের আমার জন্মভূমি। ১৯৭৪ সালে নির্মিত হল চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত সংগ্রাম, মোহাম্মদ আলী পরিচালিত বাংলার ২৪ বছর এবং আনন্দ পরিচালিত কার হাসি কে হাসে। ১৯৭৩ সালে নির্মিত ছবিগুলোর উপজীব্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বাংলাদেশের সমসাময়িক সামাজিক অবস্থা। যুদ্ধোত্তর সামগ্রিক হতাশা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল বিষয়বস্তু। খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ সমকালীন হতাশাকে ধরতে পেরেছিল সবচেয়ে আন্তরিকভাবে। সেই সময়ের মানুষের হতাশা ও বেদনাকে ধরতে পেরেছিল ছবিটি। ব্যবসায়ও সফল হয়েছিল। এই ছবিতেও আবেগের বাহুল্য ছিল লক্ষণীয়। আবেগের সংযত ব্যবহারে অবশ্য আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা শৈল্পিক চাহিদাকে খানিকটা মেটাতে সক্ষম হয়েছিল। ধীরে বহে মেঘনায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে যুদ্ধপরবর্তী জীবন উপজীব্য হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলিও দৃশ্যায়িত হছে আন্তরিকতার সঙ্গে। অন্যান্য ছবির তুলনায় ধীরে বহে মেঘনাতে অনেকটাই মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

এর পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঘটে গেল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। পঁচাত্তরের আগে নির্মিত ছবিগুলোর ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রধান তথ্যের উপস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হয় নি। অন্তত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সৃষ্টি করে নি তেমন প্রতিকূলতা। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিল স্পর্শকাতর। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে ছবি নির্মাণ করতে হলে ইতিহাসের কিছু কিছু উপাদান যেমন শেখ মুজিব, পাকিস্তানি হানাদার ইত্যাদি প্রসঙ্গ প্রায়শই ব্যবহার করতে হয়। বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলোর কাছে এ-সব ছিল খুবই অপছন্দের। ফলে সেন্সরের নানা বাধার আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মণের প্রেরণাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে তারপরও মূলধারায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে দু-একটা ছবি হয়েছে শৈল্পিক মানের দিক তা থেকে খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। হারুনুর রশিদের মেঘের অনেক রং (১৯৭৬) পঁচাত্তর-উত্তর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি ভালো ছবি বলা যায়। এই সময়ে এ জে মিন্টুর বাঁধন হারা (১৯৮১), শহীদুল হক খানের কলমীলতা (১৯৮১), মতিন রহমানের চিৎকার (১৯৮১) শৈল্পিক বা বাণিজ্যিক কোনও দিক থেকেই খুব একটা উল্লেখযেগ্য কাজ বলা যায় না।

উনিশ শো পঁচাত্তরের পর চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ প্রাসঙ্গিক হয়েছে প্রধানত এমন সব নির্মাতাদের কাছ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রধানত যাঁদের ব্যবসায়ের উপজীব্য নয়, উদ্দেশ্য চলচ্চিত্র মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করা। তাঁরা দেশের এক ধরনের সাংস্কৃতিক এলিট হিসেবে যেন নিজেদের পরিচিত করতে চাইলেন। এই নির্মাতারা সত্তরের ও আশির দশকের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পরিমণ্ডল থেকে উঠে এসেছেন। প্রচুরসংখ্যক ভালো বিদেশি চলচ্চিত্র দেখে তাঁদের নিজস্ব চলচ্চিত্র বোধকে উন্নীত করে নিতে চেয়েছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁরা সেই ভালো ছবির রসাস্বাদনের অনুপ্রেরণা থেকেই। তাঁরা অনুভব করলেন যে প্রচলিত চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির মধ্যে থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে শৈল্পিক সাফল্য আসবে না। শিল্পতৃষ্ণ স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীদের যেমন সন্ধান করলেন তাঁরা তেমনি অনুসন্ধান করলেন দর্শকের কাছে পৌঁছবার বিকল্প পথও। সাধারণভাবে এঁদেরকেই বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা বলা হয়ে থাকে। এক দিক থেকে দেখতে গেলে প্রভাব সৃষ্টিকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র এই ধারার নির্মাতার হাত থেকেই এসেছে। প্রসঙ্গত আমরা মার্কিন আলোকচিত্রী-সাংবাদিক লিয়ার লেভিনের তোলা ফুটেজ ও বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রদৃশ্য অবলম্বনে তারেক মাসুদ পরিচালিত মুক্তির গান (১৯৯৫) ছবিটির কথা উল্লেখ করতে পারি। বলা যায় সামান্য কিছু অংশ বাদে এর সকল দৃশ্যই প্রামাণ্য বলে এই ছবিটিতেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার যথার্থ ঐতিহাসিক পটভূমিতে স্থান পেয়েছে। সমগ্র দেশের নাগরিক জীবনে এই চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সতেজ অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তার আগেই, আশির দশকে নির্মিত হয়েছিল মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনি নির্ভর ছবি আগামী (১৯৮৪)। তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্যরে হুলিয়াকে (১৯৮৫) পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলা যাবে না। তবে হুলিয়াকে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব রাজনৈতিক পটভূমির ছবি বলা যায়। অবশ্য তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬), চিত্রা নদীর পারে (১৯৯৯) সম্পূর্ণতই মুক্তিযুদ্ধের ছবি। নাট্য নির্দেশক হিসাবে খ্যাতিমান নাসিরুদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র একাত্তরের যীশু (১৯৯৩)। উল্লিখিত তিনটি ছবিই স্বল্পদৈর্ঘ্যের। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত আগুনের পরশমণি (১৯৯৪) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবির মধ্যে খানিকটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ছবিতে নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতার টুকরো ছবি ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হিসাবে মূলধারার পরিচালক খান আতাউর রহমান এখনো অনেক রাত (১৯৯৭) এবং চাষী নজরুল ইসলাম হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭) নির্মাণ করলেও ছবিদুটি জনচিত্তে তেমন সাড়া জাগাতে পারে নি।

যাদের বিকল্প ধারার নির্মাতা বলা হল তাঁদের অনেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেন নি, বরং তাঁরা মূলধারার চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির সঙ্গে থেকে ছবি নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন। যেমন তারেক মাসুদ নির্মাণ করলেন মাটির ময়না (২০০২), তৌকির আহমেদ নির্মাণ করলেন জয়যাত্রা (২০০৪), হুমায়ূন আহমেদ পুনরায় নির্মাণ করলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া (২০০৪), মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করলেন খেলাঘর (২০০৬), তাঁর আর একটি চলচ্চিত্র দুখাইকে ঠিক মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলা না গেলেও ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধ প্রাসঙ্গিক হয়ে এসেছে। কারিগরি ও শৈল্পিক দিক থেকে এগুলোর গড় মান আগেরগুলোর তুলনায় উন্নততর হলেও স্বীকার করতে হবে যে, এই চলচ্চিত্রগুলোর কোনওটিই দেশের প্রকৃত চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে পৌঁছতে পারে নি। মাটির ময়না আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়ে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে সত্যি, তবে কোনও অর্থেই যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রকৃত অবস্থার প্রতিনিধি নয় তা হয়তো অনেকেই স্বীকার করবেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিতে এর নির্মাণ সম্পন্ন হলেও ছবিটি বিদেশি বিনিয়োগে ও সার্বিক সহযোগিতায় নির্মিত। ফলে একে মূলধারার চলচ্চিত্রের সামগ্রিক সংস্কৃতির প্রতিনিধি বলা যায় না।

সরকারি অনুদানে, বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর উদ্যোগেও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হারুনুর রশিদ পরিচালিত আমরা তোমাদের ভুলব না (১৯৯৩), রফিকুল বারী চৌধুরী পরিচালিত বাংলা মায়ের দামাল ছেলে (১৯৯৭) এবং বাদল রহমান পরিচালিত ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ (২০০৮)-এর কথা উল্লেখ করা যায়। ছবিগুলো নির্মাণে বিনিয়োগকৃত অর্থের বিনিময়ে মুনাফার আকাঙ্ক্ষা না থাকলেও বা অর্থসংকট প্রধান না হলেও কারিগরি ও শিল্পগত দিক থেকে গ্রহণযোগ্য মান অর্জন করতে পারে নি।

সামগ্রিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর দিতে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, ছবিগুলো নির্মিত হয়েছিল প্রধানত মধ্যবিত্ত জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বাস করলেও এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষার কারণ ও প্রেরণার সূত্র থাকলেও তার যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নেই। তাছাড়া নরহত্যা, নারীধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদি ঘটনা মানবতার লাঞ্ছনার জন্য কতটা দায়ী তাকে যথার্থ গুরুত্ব দেয়ার চেয়ে এইসব দৃশ্য চিত্রায়নের ক্ষেত্রে বীভৎসতা আরোপ করে স্থূলভাবে দর্শক টানার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মানবতার বিপর্যয়কে উপজীব্য করার চেয়ে কাঁচা আবেগকেই প্রধানত ব্যবহার করা হয়েছে বেশি। দু একটি ব্যতিক্রম বাদে একাত্তর সালের দৃশ্য নির্মাণে বিশ্বস্ততার অভাবও ছবিগুলোতে মোটাদাগে লক্ষ করা গেছে। যাঁরা ভালো ছবি প্রচুর দেখে, নানা প্রশিক্ষণ নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন দিক থেকে তাঁদের মধ্যে কিছুটা উন্নতি লক্ষণীয় হলেও তাঁরা এখনও যথেষ্ট সাফল্য দেখাতে পারেন নি। তবে চলচ্চিত্র চর্চার পথ আগের চেয়ে সুগম হয়েছে। আশা করা যায় সুফল ফলবে।

ahmadmazhar63@gmail.com
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved