মায়ের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ


জাকিয়া সুলতানা:
আমার প্রাণবন্ত মা প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে হাসতে ভুলে যান। এ মাস আমার মায়ের জীবনের এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মাস। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি মায়ের ডিসেম্বর কে ঘিরে দুঃখভরা স্মৃতির কথা।
একাত্তরে মা ছিলেন তরুণী। ৭০-এর প্রথমদিকে তার বিয়ে হয়। কিন্তু নানু অসুস্থ থাকায় থাকতেন নানাবাড়িতে। একাত্তরের প্রথমদিকেই ঢাকায় মিছিল-মিটিং জোরদার হলো। পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বাধীনতা চাচ
্ছে। ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়া স্বাধীনতার দাবি আমাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালির বাউফলেও। চারদিকে যুদ্ধের দামামা শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের গ্রামে ক্যাম্প গেড়েছে। চারদিকে আতঙ্ক। মা-বোনদের কোনো নিরাপত্তা নেই।
এমনই এক উতলা সময় আমার দাদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বউমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হলো তার। এক রাতে হুট করে আব্বা মাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন।
আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। এ রাজাকাররা পাক সেনাদের কাছে বাবার নাম জমা দিয়েছিল। তাই বাবা বেশিরভাগ সময় রাতে বাড়িতে থাকতেন না। এদিকে দাদি অসুস্থ। মাকে তাই বাড়িতেই থাকতে হতো।
এক রাতে গ্রামের এক চিহ্নিত রাজাকার আমাদের ঘরের রাখাল ইউনুস চাচার কাছে বাবার কথা জানতে চাইল। চাচা জানতেন ওই রাজাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে পাকবাহিনীর পক্ষে কাজ করছে। তরুণী বউ-ঝিকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। চাচা তাকে বাবার খবর বললেন না।
বরং রাজাকার চলে যাওয়ার পরে তিনি মাকে বললেন, ভাবিসাব আপনার অনেক বিপদ। আপনে রাতে ঘরে থাইকেন না। আপনার দিকে বদনজর পড়ছে। রাত পোহানোর আগে আপনি এ বাড়ি ছেড়ে দিয়েন।
এ অবস্থায় কী করবেন মা বুঝতে পারছেন না। তবুও সাহস হারালেন না। দাদিকে সব খুলে বললেন। দাদী বলেন, এখন উপায়? আমার মা বলেন, একটা কিছু উপায় বের করতেই হবে। আমাদের গরু ছিল বেশ কয়েকটি। মা রাখাল চাচাকে বললেন, তাড়াতাড়ি চাড়িতে পানি ভরে দাও এবং উপরে কিছু খড়কুটো দিয়ে রাখ। আমার মা এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতে লাগলেন তাকে রক্ষা করার জন্য। রাত সাড়ে বারোটার দিকে আমাদের বাড়ির চারদিক সার্চ লাইটে ভরে গেল। মা নিজেকে রক্ষা করতে সেই চাড়ির ভেতর গিয়ে বসে রইলেন। আর দাদিকে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন যদি কেউ আসে তাহলে বলবেন যে আমার ভাই এসে আমাকে নিয়ে গেছে।
পাক বাহিনীর দল আমাদের ঘরদোর তছনছ করে করে খুঁজল মাকে, না পেয়ে আমার দাদিকে ওরা হেঁচকা টান দিয়ে খাট থেকে নিচে ফেলে দিল। তারপর ওরা চলে গেল। আমার মা ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সারা রাত চাড়ির ভেতরে থাকাতে তার পেটের বাচ্চা মরে গেছে। আজানের দিকে আমার মায়ের পেটে ব্যথা শুরু হলো। ওই অবস্থার মধ্যেই মা বাড়ি ছেড়ে পালালেন। মা হাঁটছেন, আবার কিছুক্ষণ বসছেন। এভাবে তিনি চার থেকে পাঁচ মাইল হাঁটালেন। বেলা তখন প্রায় আট-নয়টা। গ্রামের লোকজন ক্ষেতে-খামারে কাজ করছে। এক লোক ক্ষেতে ভাত খাচ্ছেন। মা বলেন চাচা আমাকে পানি দেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—কে তুমি মা? মা বললেন—আমি কিছু জানি না। আপনি আমাকে বাঁচান। এ কথা বলে মা ক্ষেতে শুয়ে পড়লেন। মায়ের রক্তক্ষরণ শুরু হলো। চাষী লোকটি দৌড়ে বাড়ি থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে আসলেন। তারা মাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মায়ের পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেল। তারা ডাক্তার এনে অজ্ঞান মাকে চিকিত্সা করালেন। বিজয়কে সামনে রেখে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে মায়ের জীবেন ঘটে যাওয়া এই ট্র্যাজেডির কথা শুনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জেনেছি। কিন্তু বিজয়ের মাসে সবাই আনন্দ-উল্লাস করলেও আমরা করি না। কারণ সেই রাজাকারই এখন বড় মুক্তিযোদ্ধা!
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved