একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আত্নার কাল্পনিক কথা



বিশালাকায় কোন মানচিত্র নয়, ছোট্র একটি মানচিত্রের পিঠ চাপড়ে বললাম "তুই ভাল থাকিস।" সবুজ আর লালে উড়তে থাকা পতাকাকে বললাম "তুই আমার দেশ, তুই উড়িস মাকে নিয়ে" আমি চললাম। ভয় পাসনে আমার গায়ে যে রক্ত দেখছিস সেটা রক্ত নয় ঘাম। এই ঘামের পরিশ্রমে মানচিত্র আর পতাকাকে উড়তে দিয়েছি। এই ঘামের প্রতিটি বিন্দু হিসাব করা। কেবল আমি নই লাখ লাখ মানুষ এই ঘাম ঝরিয়েছে।এই ঘামের অবহেলারও হিসাব হবে। হুমম এভাবেই বলতে বলতে চলে গিয়েছিলাম।আজ আবার ফিরে আসলাম। না না জীবন্ত হয়ে না, আত্নার কিছু দ্বায় নিয়ে। আমি নিজেই জানিনা আমি কোথায় সমাহিত হয়েছি। আদৌ কি সমাহিত হয়েছি কিনা? তবে এটা জানি আমার ধর্মের রীতি অনুযায়ী দাহ হয়ে ছিলাম। আমার হাঁড়ের অবশিষ্ট কোন টুকরো আছে কিনা সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত না। আমার নামইতো বিলীন হতে বসেছে। বাংলাদেশের মানুষই যখন আমার ঘামের কথা ভুলতে বসেছে মাটিই বা কি করবে।

কবিতা লেখার বড় বেশী শখ ছিল। সময়ে পেলেই লিখতে বসে যেতাম। পরাধীন দেশে কবিতা লিখেও শান্তি নেই। নিজের মত কিছুই করতে পারছিলাম না।কবিতাতো পরের কথা হাট বাজারে যেতেই ভয় পাচ্ছিলাম।পাকিস্থানীরা ওত পেতে আছে। তার উপর আমি ছিলাম হিন্দু। যুদ্ধ হবে বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু নিজে গিয়ে যুদ্ধ করবো এতটুকু কখনই ভাবিনি। বরাবরই আমি নিরীহ গো-বেচারা, ভীতু ছিলাম। পাড়ার রমেশের সাথে কথায় পারতাম না আর পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো? অথচ কি অবাক করার মত কথা, আমি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি, শহীদ হয়েছি। তারচে অবাক করার ব্যাপার হল “আমাকে এবং আমাদের নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ বাজার বসিয়ে দিয়েছে।” কোন সেক্টরে ছিলাম ঠিক জানিনা। ছিল না কোন প্রশিক্ষন। যুদ্ধটা আমি করতাম না। কবিতাতে মাঝে মাঝে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করা পর্যন্ত হয়ত থেমে থাকত। কিন্তু সেদিন মাসির বাড়ী গিয়েছিলাম তাদের আমাদের বাড়ী নিয়ে আসতে। তাদের ওইদিকে পাকিস্থানীদের উৎপাৎ বেশী। মা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। মাসি আমার এক ধাপ এগিয়ে, তিনি কিছুতেই আসবেন না।মাসী ছাড়া বাড়ী এসে দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার বাড়ী, গ্রাম। আমার মা,বোন,দাদা কাউকে জীবিত পেলাম না, এমনকি মৃতও না। বাবা মারা গেছেন বছরখানেক আগে। আমার সেদিনকার অনুভুতি বুঝাতে পারবো না।নিরীহ আমার আর কোন অবলম্বন নেই। গ্রামে থাকা নিরাপদ না, কাছের মানুষদের কথা ভুলে গিয়ে চলে গেলাম অজানার উদ্দেশ্যে। ভীড়ে গেলাম “গেরিলা” নামক একটি দলে।অস্ত্র চালাতে পারতাম না। আসলে কবিতা লেখা ছাড়া কিছুই করতে পারতাম না। আমাদের দলনেতা ছিলেন রুবেল ভাই।অদ্ভুত বলিষ্ঠ এই লোক যেমন অস্ত্র চালাতেন তেমন সুন্দর গানও গাইতেন।প্রায় তিনি আমাকে বলতেন “সতীশ আজ কি কোন কবিতা লিখেছিস? একটা শোনাতো দেখি” আমি মহা আগ্রহে শোনাতাম। যোদ্ধাকে একটু শান্তি দেয়াই ছিল আমার এক প্রকার যুদ্ধ।

যোদ্ধাদের দলে ঢুকে আমিও যোদ্ধা হয়ে গেলাম। মনে পড়ে যেদিন প্রথম ষ্ট্যনগান হাতে নিই হাত কাঁপছিল ভীষন । এত ভারী একটা জিনিস কিভাবে বয়ে বেড়ায়? আমারতো দুমিনিটে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। আমার সকল প্রশ্নের উত্তর “দেশপ্রেম”। যেখানে সবাই প্রাণ দিতে প্রস্তুত সেখানে বয়ে বেড়ানোটাই সামান্য। এরপর কিন্তু আমি কাঁধে ষ্ট্যানগান বয়ে বেড়িয়েছি। আমার হাতে খুন হয়েছে গোটা পাঁচেক পাকিস্থানী আর্মি এবং পুরো আর্মির একটি ক্যাম্প।সেখানেও ২৫-২০ জন আর্মি ছিল।



আমি আপনাদের আমার কোন অপারেশনের কথা বর্ণণা করবো না। সেটা কম বেশী আপনারা সবাই জানেন। আমি শুধু আমার নিজের কিছু কথা জানাবো। বাবা ছিলনা, বোনটিও প্রায়শ অসুস্থ থাকতো। মাকে তাই রান্নায় সাহায্য করতে হত। সেখান থেকে রান্নাটা শিখে গিয়েছিলাম। আমার মূল কাজ ছিল রান্না করা। আমাদের দলে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বুদ্ধিতে, সাহসে, অস্ত্র চালানোতে আমিই সবচেয়ে দুর্বল ছিলাম। তাই রান্নার কাজে আমি বেশ যোগ্য ছিলাম। মাঝে মাঝে ক্লান্ত সবাইকে দুএকটা কবিতা শুনাতাম।তারা বেশ মজা পেত। এটাই আমার ভাল লাগত। আমি গেরিলা দলে মিশে যাই এপ্রিলের মাঝামাঝি। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতিবেলা আমি রান্না করেছি। এপ্রিলে আমরা ১৭জনের রান্না করতাম ,জুলাইয়ে এসে ১৪জনের খাবার রান্না করতে হত। এরপর আমি চলে যাবার পর তারা ১৩ হয়ে গিয়েছিল। জানিনা তারা কিভাবে রান্না করেছিল নাকি আরও চলে গিয়েছে নাকি।আমি যেদিন চলে যাব সেদিন সকাল থেকে এক ধরনের অস্থিরতা ছিল।আমরা বুঝতে পারছিলামনা আমরা জিতবো কি হারবো।পতাকা উড়ানোর জন্য মনে মনে ঠিকই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।আমাদের খুব কাছেই পাকিস্থানী আর্মি ক্যাম্প বসিয়েছিল। সবাই বসে প্ল্যান করছিল কিভাবে আর্মির ক্যাম্পে হামলা চালানো যায়। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল আত্নঘাতি হামলা করা হবে। কিন্তু কে যাবে শরীরে গ্রেনেড বেঁধে? সবাই রাজি। আমি সবাইকে বুঝালাম “আমি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অন্যদের একজন গেলে আমাদের শক্তি কমে যাবে, আমি গেলে ক্ষতিটা কম হবে” আমার যুক্তি নিয়ে আলোচনা হল। শেষে সিদ্ধান্ত নিল আমিই যাব।মরে যাব ভেবে একটু খারাপ লাগছিল তবে আনন্দটা বেশী লাগছিল। আমি যদি আমার কাজে সফল হই আমার একজনের বিনিময়ে আমরা বিশজনকে ধ্বংস করতে পারব। কিন্তু আমার থেকে আমার দলের অন্যদের মন বেশী খারাপ ছিল।কি যেন একটা বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। জানি সবাইকে আর পাবনা, নিজেকেও পাবনা, বিকেলে দীঘির জলের ছায়া কবিতাও লিখা হবে না, মাধবী নামক যে মেয়েটিকে মনে মনে চাইতাম তাকেও পাব না। কিন্তু এটা জানি একটা দেশ পাব,মানচিত্র পাব আর পাব একটি উড়ন্ত পতাকা। প্ল্যান যতটা সহজ ছিল আর্মি ক্যাম্পে প্রবেশ করা অত সহজ ছিল না। কিন্তু আমি পেরেছিলাম।উড়ে গিয়েছিল পুরো আর্মি ক্যাম্প। এরপর আমি আর কিছুই জানিনা।



বেঁচে থাকলে কি করতাম জানিনা। শুনেছি আমাদেরকে নিয়ে নাকি রমরমা ব্যবসা হচ্ছে।সার্টিফিকেট দিয়েও চিন্হিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।শুনে খুব লজ্জা পেয়েছি। এতটা যদি ওসময় চিন্তা করা যেত তবে আমাদের স্বাধীন হওয়া কখনই হত না।আমার আত্নার ডাকেই হাড়গোড় বিহীন আমি মাঝে মাঝে জেগে উঠি। জেগে উঠি পল্টন ময়দানের মিথ্যাচারে। বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুব আফসোস হয়, বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা হয়ত শহীদ না হওয়াতে আফসোস করছেন।এই আফসোস মনে হয় সারাজীবন চলতে থাকবে। কখনই ভাবিনি আমাদের এত বড় অর্জন একসময় আফসোসের কারন হবে। রাজনীতিবিধ নামক কিছু প্রাণী পুরো দেশটাকে ধীরে ধীরে হজম করে নিচ্ছে। স্বাধীনতা, মানুষের সবরকম চাহিদা একে একে কেড়ে নিচ্ছে।দেশের মানুষের মনে একধরনের মানষিক যুদ্ধ চলছে। খুব বেশীদিন হয়ত নেই আরেকটি যুদ্ধের। ৭১য়েও আমরা বহুদিন মানষিক যুদ্ধ করেছি, পাকিস্তানীদের সহ্য করেছি। ৭১ ফিরে নিশ্চয় আসবে। সেদিনের অপেক্ষায় মৃত শরীরে আমার জীবিত আত্না।



(এটি একটি কাল্পনিক গল্প, শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা কখনই জানবেন না বর্তমান বাংলাদেশে কি হচ্ছে, কত নোংরাভাবে আমরা তাদের দানের পতাকাকে, মানচিত্রকে অবহেলা করছি। আমার এই গল্প শহীদ হওয়া এবং বেঁচে থাকা সব মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করলাম। আমরা আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা আসলেই কখনই বুঝবো না কতটা আত্নত্যাগ স্বীকার করেছেন আপনারা)

মুক্তযুদ্ধের কাল্পনিক গল্প লেখা বিরাট সাহসের ব্যাপার। কল্পনা থেকে অনেক বেশী কিছু হয়েছিল। ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী।    

মূল লেখা : http://www.somewhereinblog.net/blog/3741/29501643
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved