। মূল আক্রমণকারী দল রায়গঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। গোলাগুলি চলার একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহী একটি গাড়ি উপস্থিত হয় মাজহারুল হকের অবস্থানে। তখন তাঁরা ওই গাড়িতে আক্রমণ চালান। তাঁদের অস্ত্রের গুলি ও নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডের আঘাতে গাড়ি ধ্বংস এবং বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মাজহারুল হকদের এই আক্রমণ ছিল ভূরুঙ্গামারীতে চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতির অংশ। কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত ভূরুঙ্গামারী। ওই ঘটনার পর ১১ নভেম্বর রাতে তাঁরা ভূরুঙ্গামারীর এক দিক খোলা রেখে তিন দিক দিয়ে একযোগে আক্রমণ চালান। তাঁদের তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ১২ নভেম্বর সকাল আনুমানিক আটটায় মিত্র বাহিনীর বিমান ভুরুঙ্গামারীর পাশে পাটেশ্বরী রেলস্টেশনের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষায় বিমান হামলা চালায়। ধ্বংস হয়ে যায় সেনাবাহিনীর পাটেশ্বরীর প্রতিরক্ষা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলস্টেশন। হতাহত হয় অনেক শত্রুসেনা। পাটেশ্বরী থেকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে শুরু করে। তখন মাজহারুল হক তাঁর দল নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন। জীবিত সেনারা পালিয়ে যায় ভুরঙ্গামারী সদরে। মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারীর পূর্বদিকে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। মাজহারুল হকও তাঁর দল নিয়ে আক্রমণ করেন। ১৩ নভেম্বর সারা দিন সেখানে যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যার পর রাতেও দুই পক্ষে গোলাগুলি চলে। শেষ রাতে পাকিস্তানিদের দিক থেকে গোলাগুলি স্তিমিত হয়ে যায়। ১৪ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভুরুঙ্গামারীতে ঢুকে পড়েন। তখন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী বিপুলসংখ্যক ইপিসিএএফ গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় পালিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ঘেরাও করেন। তারা আত্মসমর্পণ করে। এরপর মাজহারুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যান জয়মনিরহাটের দিকে। তাঁদের আক্রমণে এখানে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রায়গঞ্জে পালিয়ে যায়। ১৬ নভেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা রায়গঞ্জে আক্রমণ শুরু করেন। দুই দিন একটানা যুদ্ধের পরও পাকিস্তানিরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা ১৯ নভেম্বর ফুলকুমার নদ অতিক্রম করে তিন দিক দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধের পর শেষ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের দিক থেকে গুলি বন্ধ হয়ে যায়। সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাজহারুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়েন রায়গঞ্জে। মুক্ত হয় গোটা ভুরুঙ্গামারী। মাজহারুল হক চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন রংপুর ইপিআর উইংয়ের (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) অধীনে। তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। নাগেশ্বরী, পাটেশ্বরীসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মাজহারুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৭৮। মাজহারুল হক স্বাধীনতার পর বিডিআরে (বর্তমানে বিজিবি) কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৮৩ সালে মারা যান। তখন তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রংপুর জেলার সদর উপজেলার মাহিগঞ্জে। বাবার নাম আফসার আলী খান, মা খাদিজা বেগম। স্ত্রী সাফিয়া বেগম। তাঁদের চার ছেলে ও দুই মেয়ে। সূত্র: প্রথম আলোর রংপুর প্রতিনিধি আরিফুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টর-ভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬ এবং ১৯৭১, উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়, আখতারুজ্জামান মণ্ডল। গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান rashedtr@prothom-alo.info
সূত্রঃ প্রথম আলো
Post a Comment