দেশপ্রেমের একাল-সেকাল

যুদ্ধ শুরু হবার অল্প কিছুদিন পরেই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়ুথ ক্যাম্প। পনের কি পঁয়তাল্লিশ, যোগ্যতা এবং সামর্থ্যের বালাই নেই, প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ এসব ক্যাম্পে ভিড় জমাতো দেশের অভ্যন্তর থেকে। ক্ষীণ একটি আশা, যদি কোনো ভাবে যোগ দেওয়া যায় মুক্তিবাহিনীতে,প্রাণ দেওয়া যায় দেশের তরে। প্রতিযোগিতা প্রচুর,কারণ এত লাখ লাখ যুবক ক্যাম্পে ছিল যে সবাইকে ট্রেনিং এবং অ
স্ত্র দেবার কোনো অবস্থায় ছিলো না বাংলাদেশ সরকারের।

এমনই এক ইয়ূথ ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হাফিজ বীর বিক্রম গিয়েছিলেন সৈন্য সংগ্রহে। নিরুপায় হাফিজ উৎসাহীদের ভিড় ঠেকাতে উচ্চতা নির্ধারণ হয়েছিল পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। বাঙ্গালিদের স্বাভাবিক উচ্চতার তুলনায় একটু বেশীই বটে। যোদ্ধাদের সংগ্রহ করে হাফিজ যখন ফিরছেন ঠিক তখনই তার গাড়ির ঠিক সামনে সটান শুয়ে পড়ে এক যুবক।

উচ্চতা পাঁচ ফিটেরও নীচে, কিন্তু আত্মবিশ্বাস এবং দেশপ্রেমের উচ্চতা? আমাদের বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের সকলের দেশপ্রেমের সমষ্টির চাইতেও বহু গুণ বেশী । যশোরের ছেলে মহিউদ্দীন, অন্য দশটা সাধারণ গ্রাম বাংলার ছেলের মতই গড়পাতড়া দেহ কিন্তু চেহারায় রয়েছে অদ্ভুত দৃপ্ততা।

হাফিজের রোষের ভয় না করে বলে, "স্যার, বুকের মাপ আর উচ্চতা দেখে ভর্তি করে চলবে না। শত্রুর অবস্থান দেখান আর হাতে দিন গ্রেনেড। দিনে দুপুরে আপনার চোখের সামনেই শত্রুর বাঙ্কার ধ্বংস করে আসবো।"

না করতে পারলেন না হাফিজ, ১ম ইস্ট বেঙ্গল বা সিনিয়র টাইগারদের সাথে জুটে যান মহিউদ্দীন। কোনো যুদ্ধেই নিরাশ করেনননি হাফিজকে। ১৪ই ডিসেম্বর ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিলেটের এম.সি. কলেজ আক্রমণে নিজের সেই সাহসের দৃষ্টান্ত রেখে শাহাদাত বরণ করে মহিউদ্দীন।
------
স্বাধীন দেশে আজ মহিউদ্দীনদের মেলে না কোনো খোঁজ,আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ভাঙ্গা রেকর্ডের মত আটকে গেছে সেই ঘোষক বিতর্ক-যুদ্ধাপরাধ বিতর্কে। রণাঙ্গনে মহিউদ্দীন তৈরী হয়েছে হাজারে হাজারে,খরচও হয়েছে হাজারে হাজারে,কেউ রাখেনি হিসেব। সামরিক নিয়মানুযায়ী আক্রমণকারী বাহিনীর প্রতিরক্ষারত বাহিনীর চেয়ে তিনগুণ বেশী সৈন্য প্রয়োজন।

সে দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর যত সংখ্যা ছিল তার থেকে তিনগুণ বেশী সৈন্য দরকার ছিল আমাদের। যুদ্ধে অংশগ্রহণরত পাকিস্তানী বাহিনীর ১.৮ গুণ ছিল ভারতীয় সৈন্য। তাদের জেনারেলরা বলে বেড়ায় কীভাবে সেই ১.৮ গুণ সৈন্য দিয়ে পাকিস্তানীদের পরাজিত করলো,কিন্তু হিসেবে আনেনা মুক্তিবাহিনীকে। একই অবস্থা পাকিস্তানীদেরও। তারা লিখে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পরাজয়, মুক্তিবাহিনীর মত অনিয়মিত বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করতে তাদের আত্মসম্মানে লাগে। তবে কে বলবে আমাদের কথা? ভারতীয়-পাকিস্তানীরা? তারা তো তাদের স্তুতিতেই ব্যস্ত? আমাদের ইতিহাস আমাদেরই বলতে হবে,আমাদেরই লিখতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রজন্মের প্রদীপ নিভু নিভু প্রায়। এখনই শেষ সুযোগ আমাদের রণাঙ্গনের বীরদের গৌরবগাঁথা লিপিবদ্ধ করার। এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা,দায়িত্ব প্রচুর কিন্তু চেষ্টা যে শূন্য। যুদ্ধের চলচ্চিত্র, একশ্যান ফিল্ম কত দেখি আমরা, কিন্তু কখনো কি ইচ্ছে হয়না বাড়ীর পাশের মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা শুনতে? আর কিছু না হোক,তার গল্পটিতো অন্তত বেঁচে যাবে। আমাদের মনে রাখা উচিত যে জাতি বীরের মর্যাদা দিতে জানে না, সে দেশে আর বীরের জন্মও হবে না।
-----
তথ্যসূত্রঃ রক্তভেজা একাত্তর (মেজর হাফিজ),পতাকার প্রতি প্রণোদনা (মেজর কামরুল হাসান)


মূল লেখা: https://www.566


Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved