মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী : আকবর হোসেন




আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই, যারা বেসামরিক-তারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এদেশে ফিরে যুদ্ধে ঝাপিয়েছেন বীর বিক্রমে। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী ও আকবর হোসেনের মতো মানুষরা দেশের মাটি ছাড়েননি, বরং তা আকড়েই গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধ। আকবর হোসেন কাদের সিদ্দিকীর মতো বড় মাপের হাইলাইট পাননি, তারপরও তার মতো একজন জনযোদ্ধার তখনকার অবস্থান এবং যুদ্ধনীতি নিয়ে বইটি আমাকে অভিভূত করেছে। সেটাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে কীভাবে নেতৃত্ব জেগে ওঠে এবং সেটা মরণপন লড়াইয়ের- তা পড়ে আমার মতো অনেকেই মুগ্ধ হবেন, সন্দেহ নেই।

লেখকের কথা :

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও অর্জিত এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থান পেয়েছে বিশ্বের মানচিত্রে। আমার দেশের পতাকা আমার বুকভরা অহঙ্কার।
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর। কিন্তু বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে এসে যখন কোনো অবসর মুহূর্তে আমি আমার অতীতের স্মৃতিচারণ করি তখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি নানা কারণে আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমার জীবনটা যে শুধু বৈচিত্রময় ঘটনায় ভরপূর তাই-ই নয়, বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
যুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বপালন করা ছাড়াও অত্যন্ত অন্তরঙ্গ আলোকে প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে এই রক্তাক্ত ঘটনাবলী আমি অবলোকন করেছি।
71 এর মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আমার জীবন। তাই আমি আর কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকতে চাই না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য '71 এর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী ও তার প্রেক্ষাপট এই বইয়ে উপস্থাপন করেছি।
আকবর হোসেন
অধিনায়ক শ্রীপুর বাহিনী
মাগুরা

এক.

টুপিপাড়া ছোট্ট একটা গ্রাম। প্রবাদ আছে, কবে নাকি এক ইংরেজ সাহেব ঘোড়ায় চড়ে এই জনপদ পাড়ি দেওয়ার সময় মাথার হ্যাট পড়ে গিয়েছিল। যেখানটিতে তার টুপি পড়ে গিয়েছিল, সে জায়গাটির নাম হয়েছে টুপি পাড়া। কুমার নদীর তীরঘেষে এই গ্রাম আমার ছোট বেলার স্মৃতিতে ভরা। এই গ্রামেই আমার জন্ম। আমার জন্ম সেই ব্রিটিশ আমলে। আমার আব্বা মিয়া গোলাম কাদের ছিলেন দারুণ রাসভারী লোক। অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ও মুত্তাকী। ছোটবেলায় তিনি আমাকে মক্তবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। পরে শ্রীপুর হাইস্কুলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন চলছে তখন আমি কিশোর। মাঝে মাঝে দেখতাম আকাশে ব্রিটিশ যুদ্ধ বিমান ঝাঁ করে উড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হতো বৈমানিক হবো।

1947 সালে ভারত ভাগ হয়ে দুটো দেশ হলো। আমরা পড়লাম পাকিস্তানের অংশে। এখনও মনে পরে সেই 1947 সালের 14 আগস্টের কথা। সে কি এক আনন্দঘন দিন ছিল সেদিন। শ্রীপুর থানায় আব্দুল হাই মিয়ার নেতৃত্বে আমরা পাকিস্তানের পতাকা ওড়ালাম। আলোয় আলোয় সাজালাম থানা ভবন। কিন্তু সে আনন্দ বেশিদিন টেকেনি। ভাষা আন্দোলন শুরু হলো। আমাদের স্বপ্ন ভঙ হলো।
'48 সালের 11 মার্চ শ্রীপুরের স্কুলগুলোতে ধর্মঘট পালিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'র দাবিতে। অথচ এই আমি ছিলাম ন্যাশনাল গার্ডের সালারে গেরো আর সালারে জেলা ছিলেন মিয়া আব্দুল হাই। 'লড়কে লেঙে পাকিস্তান, ছিনকে লেঙে পাকিস্তান' পাকিস্তান জাতির শান। এমনিতরো কতো শ্লোগান আমরা মিছিলে মিছিলে তুলেছি।

1951 সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ভর্তি হলাম। প্রশিক্ষনের জন্য আমাদের পাঠানো হলো পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত জেলা শহর কোহাটে। কিন্তু পাকিস্তানীদের অশ্রাব্য গালিগালাজ অবজ্ঞাসূলভ ব্যবহার আমার মন বিষিয়ে তুলল। অবশেষে 1954 তে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলাম স্বদেশভূমিতে।

দেশে ফিরেই দেখি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন চলছে। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নাম সবখানে। 21 দফার পক্ষে জনগন রায় দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে উদর্ুওয়ালাদের আচরণ দেখে এসেছি। মনে মনে পণ করেছি তাদের সাথে থাকা আর সম্ভব নয়। দেশে এসে দেখি স্বায়ত্ব শাসনের দাবির জোয়ার। আর এই দাবির সাথে আমিও একাত্ম হয়ে গেলাম। এই দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে উন্নীত করার মহাশপথে তখনই আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম।

সোহরাওয়ার্দীর প্রতিও আমার আকর্ষণ ছিল।
সোহরাওয়ার্দীর নামে মাগুড়ায় গড়ে উঠেছে মাগুড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। তার আকর্ষনেই একদিন আওয়ামী লিগে যোগদান করলাম। এ সময়ে মুসলিম লীগের দাপট সাংঘাতিক। মুসলিম লীগের সম্পর্কে কোনো কিছু বলার উপায় ছিল না। কিন্তু আমি জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে কোমর বেধেই তাদের সঙ্গে কোমর বেঁধে বাহাছে নেমে পড়লাম। অনেক মুসলিম লীগারকেই ন্যায়সঙ্গত যুক্তিতর্কে পরাস্ত করেছি। এ সময়ে আমার সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় অনেক লোক আওয়ামী লিগে যোগ দিয়েছে। হাটে মাঠে সর্বত্রই আওয়ামী লিগের পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতে লাগলাম। ক্রমে আমাদের এলাকায় এ দল শক্তি অর্জন করতে থাকে।

দেখতে দেখতে 1965 সালের ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন এসে গেল। ইতিমধ্যে আমি শ্রীপুর থানা আওয়ামী লিগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। মাগুড়া মহকুমা আওয়ামী লিগের কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি হলাম। বিপুল দায়িত্ব মাথায় নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেলাম। উল্লেখ্য যে শ্রীপুর থানার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে একমাত্র আমিই বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। বাকি সাত ইউনিয়নের সবাই মুসলিম লীগের। তাই বলে নিরাশ হলাম না। হাল ছাড়লাম না। চেয়ারম্যান জীবনে শত-সহস্র বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। ঐ সময়ে অন্যান্য চেয়ারম্যান এমনকি সরকারী কর্মচারী সবাই আমার বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু কোনো কিছুই চলার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। আমার দৃঢ় মনোবল, আমার অবিচল আস্থা ও নিষ্ঠাই আমাকে শেষ পর্যন্ত গন্তব্য স্থানে পেঁৗছে দিয়েছে।

মূল লেখা : http://www.somewhereinblog.net/blog/omipialblog/10284
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved