কাঠপাতার ঘর



আমার বাবা আর ঠাকুর্দা দুজনে মিলে কাঠপাতার ঘর বানিয়েছিল। ছোটখাট ঘরটি। মাটির মেঝে। চালে কাঠপাতা। নতুন গাঁ থেকে বাঁশ এনে তিনটি মাঁচাও বানানো হয়েছিল। বড় মাঁচায় বাবা মা আর ভাইবোনগুলো। মাঝারি মাঁচায় বড়দিদি আর জামাইবাবু। ঘরটির একটি বারান্দাও ছিল। সেখানে আমার ঠাকুর্দা আর পাগল ঠাম্মা। দরমার বেড়া দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকত।  মাঝে মাঝে কাঠপাতার ফাঁকা দিয়ে বৃষ্টি।
বাড়ির পেছন দিকে ছিল একটা এঁদো ডোবা। আর ঘন ঘাস। এই ঘাস শুকিয়ে  হয়েছিল আমাদের প্রিয় বিছানা। এই নরম গরম বিছানায় আমরা জড়াজড়ি ঘুমাতাম। আবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখতাম। সে সময় আমাদের একটি ছোটো  বোন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ও স্বপ্ন দেখতে জানত না।

কাঠপাতার ঘরটির সামনে খোলা জায়গায় ঠাকুর্দা একদিন ফুলকপি আর পাতা কপি লাগাল। পাগল ঠাম্মা লাগাল কটি মরিচগাছ। রোজ সকালে গাছগুলিকে বকাঝকা করত, অ মরিচগাছ, তুই ধরিস না ক্যান। তুই ধরিস না ক্যান। ঠাম্মার এই ধমকে বেশ কাজও হল। কদিনে গাছগুলোর একটা চেকনাই খুলল।

দিদির ছিল কয়েকটি ঢেঁড়শগাছ। আর বাবা পালংশাকের আটি ফেলল। জামাইবাবুর ইচ্ছে ছিল কাঁঠালগাছ লাগাবেন। কিন্তু সাহস পেলেন না। তবে কয়েকসারি টমেটোগাছ লাগিয়ে বেশ যত্ন আত্তি করা শুরু করলেন। এর আগে পর্যন্ত টমেটোর নাম ছিল টক বাগুন। দাদা বিকেলে গাছগুলোকে জলদান করত। আর বুড়িদির পছন্দ ছিল গোল আলু। বাবা পূবধারে একটা আলু ক্ষেতও করল। পরের বোন দুটি অপর্ণা আর অর্চনা। অর্চনা তখন বেশ দৌঁড়ে বেড়ায় টলমলো পায়ে। আর অপর্ণা ছিল বেশ ডাকাবুকো। অপর্ণা এসে বলল, আমরা কি লাগাব?
অর্চনা ঘুরে ঘুরে বলল, আমাল গাত কই। আমাল গাত কই।

তখন আমাদের কাঠপাতার বাড়িটির সঙ্গেই ছিল ইছামতি নদী। ওপাড়ে ঘন গাছ—আর গাড়ির শব্দ। এ নদীর পাড়ে পেয়েছিলাম একটি লাউচারা। জলে ভেসে এসেছিল। জলে ভাসা মানুষের মত রোগাভোগা। বেনামা।

এই লাউচারাটিই তুলে এনে লাগালাম কাঠপাতার ঘরের এক কোণে। অপর্ণা শুকনো ঘাস আর পচা কচুরিপানা এনে গাদা করল। তার উপর লাউ চারাটি।

দেখে বাবা রেগে গেল। চারাটি লাগাতেই দেবে না। বড় হলে চালের কাঠপাতা নষ্ট হয়ে যাবে। গাছটি উপড়ে ফেলতে যাবে—তখন ছোটো বোনটি অর্চনা গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে পড়ল। বলতে লাগল, আমাল গাত। আমাল গাত।
গাছটি রয়ে গেল।
আমরা তিনজন প্রতিদিন গাছটিতে জলদান করতাম।

আমাদের লাউগাছটি বেশ কদিন ছোটোমোটো হয়ে থাকল। নড়ে না। নড়ে না। বাড়ে না। আর আমাদের বাগানের বেগুন, টমেটো, ফুল কপি, সিম বড়বটি বেশ ফালিয়ে ফালিয়ে বাড়তে লেগেছে। লতায় পাতায় ডগায় বেশ ডগডগে সবুজ হয়ে হয়ে উঠছে।
এ জন্য অপর্ণার মুখ কালো। আর অর্চনা গাছটির কাছে ঘুরে ঘুরে বলে, ও গাত, তুমি বল হবা কবে?
আমার ঠাকুর্দা একদিন গাছটির গোড়ার মাটি খুঁচিয়ে দিল। আর দিল একটু গোবর পচা। এর কদিন পর থেকেই গাছটির চেহারা ফিরতে শুরু করল। নতুন পাতা ছাড়ল। সবুজ হল। আঁকশি বেরুল। কটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গাছটির চারদিক ঘিরেও ফেলা হল।

তখন আমাদের বাগানের ঢেঁড়শ খেতে শুরু করেছি। লাল শাক খাচ্ছি। পালং শাক খাচ্ছি। মরিচগাছে ফুল আসছে। ওলকপি গোল হচ্ছে। কাঠপাতার ঘরটির চারিদিকে একটা ছিরিছাঁদ ধরেছে।

আমাদের কাঠপাতার বাড়িটির সামনে একটি কলেজ ছিল। নাম খয়রামারি কলেজ। এইখানে খয়রা পাখি নামত বলে এই নাম। বিকেলে কলেজ মাঠে কেউ কেউ ব্যাড মিন্টন খেলত। খেলত ভলিবল। আর ক্রিকেট। চার ছয় হলে ক্রিকেটবল আমাদের বাগানে এসে পড়ত। টমেটোগাছে, বেগুন গাছে আলু গাছের ডগা ভেঙ দিত। কোনো কোনো বল তারা খুঁজে পেত। কোনো কোনোটি পেত না। আমরা পেতাম। এগুলো ছিল আমাদের হাওয়ায় পাওয়া বল।

লাউগাছটির সামনে তখন হাত তুলে অপর্ণা অর্চনা আর আমাদের পাগল ঠাম্মা দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অপর্ণা বলত, অ বল, তুই ইদিকে আসিস না। অর্চনা বলত, বল, তুই পতা। আর ঠাম্মা বলত, তফাৎ যা। তফাৎ যা। বল সত্যি সত্যি তফাৎ যেত। আমাদের লাউগাছটির ধারে কাছেও ঘেষত না।

লাউগাছটি এক সময় অর্চনার মাথার উপরে চলে গেল। তারপর অপর্ণার। তারপর আমার। একদিন পাগল ঠাম্মার মাথাও ছাড়িয়ে গেল। কাঠপাতা ছুঁই ছুঁই হয়ে যাবে আর কিছু দিনের মধ্যেই। একদিন মা ডালে ফোড়ন শেষে গাছটি ঘুরে ঘুরে দেখল। মায়ের মুখে হাসি। অর্চনার মুখেও হাসি। অর্চনা বলে, আমাল গাত। মা বলে, হু।
অপর্ণা বলে, হু কি মা?
–কুঁড়ি আসতেছে।
–ফুল আসবে?
–ফুল আসবে। লাউ ধরবে।

ফুল আসার সময় হতে হতে ইছামতির ওপাড় দিয়ে ঘড় ঘড় করে ট্যাংক যাওয়া শুরু করল। আমাদের মাথার উপর দিয়ে কামানের গোলা ছুটে যেতে শুরু করল। আকাশ জুড়ে উড়তে লাগল প্লেন। আর রাতে সব আলো নিভে যেত। বাইরে কন কণে হাওয়া। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ত।  এর মধ্যে আমরা শুকনো ঘাস গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতাম। বাইরে লাউগাছ বাড়ত। ঠাম্মা শ্বাস ফেলত। ঠাকুরদা বারান্দার ঘরে থেকে থেকে বলত, জয় বাংলা আইতাছে। জয় বাংলা আইতাছে।

সত্যি সত্যি একদিন জয় বাংলা এল  কড়া শীতের মধ্যে। তখন ডিসেম্বর মাস। আমাদের বাগান ভরা শাকসবজি ফলতে শুরু করেছে। একদিন ট্রাক এল। আমরা ট্রাকে উঠে পড়লাম। মা সামান্য একটু কাঁদল কাঠপাতার ঘরটির জন্য। ভর ভরন্ত সবজি বাগানটির জন্য।  হারিয়ে যাওয়া বোনটির জন্য। অপর্ণা ফিরে ফিরে দেখতে লাগল লাউগাছটিকে। গাছের কাছে একটি চড়ুই পাখি। কঞ্চির উপরে চুপ করে বসে আছে। অর্চনা বাবার কোলে গলা ফাটাল, আমাল গাত। আমাল গাত।

যশোর রোডে আমাদের ট্রাকটি ঢুকে পড়লে পাগল ঠাম্মা অদ্ভুতভাবে বড় বড় শিরিশগাছগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখতে লাগল, আমাদের লাউগাছটি কাঠপাতার ঘরের চালে উঠে গেছে। তারপর কাঠপাতার ঘরটি ছেড়ে হাওয়া বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে।  সত্যি সত্যি হাওয়া  বেয়ে আকাশে উঠে গেছে। উঠে লাউগাছটি  বলছে, অ ঠাম্মা, বলো তো, কেডা আমি?
ঠাম্মা অর্চনার মতো করে বলে, আমাল গাত। আমাল গাত। 

মূল লেখা: http://shoily.com/?p=7502
Share this post :

Post a Comment

 
Support : Copyright © 2012. মুক্তিযুদ্ধের গল্প - All Rights Reserved