সুযোগমতো লক্ষ্যবস্তুর সন্দানে ছুটে বেড়াই আমরা। শত্রুর অবস্থানের ওপর
হামলা করা(রেইড) অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজ। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ,
সাহস ও অভিজ্ঞতার, সর্বোপরি এগুলোর সূক্ষ সংমিশ্রনের। সে অবস্থায় আমরা তখনো
পৌছিনি। আমাদের যুদ্ধ প্রধানত শত্রুর চলন্তযানবাহনের ওপর আকস্মিক আক্রমন
বা এম্বুশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তেমনি এক এম্বুশের জন্য ইলিয়টগঞ্জ বাজারের
উত্তরে পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে হাইডআউট স্থাপন করে শত্রুর গতিবিধি ও আচরণ
পর্যবেক্ষণ করার জন্য কয়েকদিন অবস্থান করতে হচ্ছে। বাহার নামে একটি ছেলে
এসে একদিন অনুরোধ করল কয়েকদিন ছুটির জন্য। বলল, আমরা যে গ্রামে আছি তার
বাড়ি খুব কাছেই কোনো গ্রামে, যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে ও বিয়ে করেছিল। তারপর
আর স্ত্রীর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। একরকম অপরাধীর মতোই বলল, তার বাড়ীর এত
কাছাকাছি না এলে সে এরকম অনুরোধ করত না। ছেলেটির বয়স কত হবে-18, 19,20।
আমার খুব মজা লাগছিল। পরিচিত হবার পর একটু বেশি ভালো লাগে, আমাদের বাহার
তেমনি এক ছেলে। এই ক'দিনের রেকির কাজে বাহারের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোনো
প্রভাব ফেলবে না। বাহার ছুটির অনুমতি পেল।
দুদিন পরই দেখি বাহার আমাদের ক্যাম্পে। অবাক হলাম ওকে দেখে। ভাবলাম ও কোনো কারণে হয়তো বাড়ি যায়নি। জিজ্ঞাস করতেই বাহার আমার সঙ্গে একান্তে কথা বলার অনুমতি চাইল। আমার বিস্ময় আরো বাড়ল। ঘরে ঢুকে যা বলল তা শুনে আমি একাধারে বিস্মিত, বিব্রত ও পুলকিত। বাহারের অনুরোধ, তার বাড়িতে আমাদের এক বেলা খেতে হবে। বাহার যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে তার বৌ তাদের দেখতে চায়। বাহার যে আর সবার সাথে সত্যি সত্যিই বর্বর পাকিস্তানীদের হত্যা করছে ওর বৌর তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে আমাদের জন্য রান্ন া করবে। এই দাওয়াতের শেষ অংশে একটা বিশেষ অনুরোধ ছিল। বাহার প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, সে গরিব মানুষ। তার স্ত্রী আমাদের সবাইকে (44জন) খাওয়াতে চায় কিন্তু তার আর্থিক সঙ্গতি নেই। আমরা 4/5জন যেন যাই। আমি বিব্রত। তারপরও রাজি হলাম।
দুই কোঠার ছোট্ট একটি ঘর। মাঝখানে তরজার বেড়া। আয়োজন সীমিত হলেও খাবার ছিল বেশ উপাদেয়। আমরা ক'জন পেট ভরেই খেলাম। বাহার ও তার স্ত্রীর আতিথেয়তা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো। এ যাবত বাহারের স্ত্রী আমাদের সামনে একবারও আসেনি। খাবার শেষ হওয়ার পর বেড়ার ওপাশ থেকে বাহারের স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে দেহের অর্ধাংশ বের করে দাড়াল।'আসসালামু আলাইকুম'
15/16 বছরের এক কিশোরী মেয়ে। আমরা সালামের জবাব দিয়ে বললাম'আপনার রান্না খুবই মজার হয়েছে। আমরা পেট ভরে খেয়েছি।'
এ জবাবে একটা ধন্যবাদ আসার কথা। কিন্তুগ্রামে বোধহয় এ ধরণের ধন্যবাদের চল নেই। খাবারের আয়োজন ঠিকভাবে করা হয়নি, আদর-আপ্যায়নের অভাব ছিল- স্বাভাবিক লৌকিকতার এ ধরণের কোনো কথাই সে আর বলল না। কিছূক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলবে ভেবে আমরাও চুপ করে রইলাম।
'স্যার আমাদের উনি কি ভালো যুদ্ধ করে না?'
'কেন, বাহার তো খুবই ভালো যুদ্ধ করে। ও খুবই সাহসী' আমি অপ্রস্তত হয়ে বললাম।
'তাহলে যে স্যার এই কয়দিন উনি বাড়িতে। আপনারা ওনারে যুদ্ধে নেন না?'
একি অনুযোগ! বিস্মিত হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। এ প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহী উত্তর আছে কিন্তু সে উত্তর এ মেয়ের বুঝবার কথা নয়। মুখ দিয়ে আমাদের কারোরই কথা সরছে না। ঠিক এ অবস্থায় পড়ব আমাদের কারোরই বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। অপলক নয়নে সদ্য পরিণীতা কিশোরী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা কেউই বয়সে বিশের কোঠা ছাড়াইনি। মেয়েটি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, না আরও কিছু বলবে অনুমান করতে পারছি না। তবে সে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, ঘোমটা মাথায় ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। যুদ্ধ যে নির্ঘাত মৃতু্যর এক সমূহ সম্ভাবনা এ কিশোরীরও তা না জানার কথা নয়। কোন প্রনোদনা যুবক স্বামীকে সেই মৃতু্যর সামনে দাঁড় করাতে উৎসুক? এ কেমন ভালোবাসা?
মনে মনে বললাম, 'শোন মেয়ে। যতদিন তোমরা আছ, যতদিন তোমাদের মতো অন্তপুরের যোদ্ধারা আমাদের মতো সৈনিক তৈরি করবে ততদিন এ জাতির ভাবনার কিছু নেই, আমাদের এগিয়ে যাওয়াও থামবে না। কিছু রক্ত অবশ্যই ঝরবে, কিজানি তোমার পিন্ধনেও হয়তো বা সাদা শাড়ি উঠবে তবে তোমার এ ছোট্ট ঘরে একটা বড় লাল-সবুজ পতাকা আমরা উড়াব ইনশাল্লাহ।'
দুদিন পরই দেখি বাহার আমাদের ক্যাম্পে। অবাক হলাম ওকে দেখে। ভাবলাম ও কোনো কারণে হয়তো বাড়ি যায়নি। জিজ্ঞাস করতেই বাহার আমার সঙ্গে একান্তে কথা বলার অনুমতি চাইল। আমার বিস্ময় আরো বাড়ল। ঘরে ঢুকে যা বলল তা শুনে আমি একাধারে বিস্মিত, বিব্রত ও পুলকিত। বাহারের অনুরোধ, তার বাড়িতে আমাদের এক বেলা খেতে হবে। বাহার যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে তার বৌ তাদের দেখতে চায়। বাহার যে আর সবার সাথে সত্যি সত্যিই বর্বর পাকিস্তানীদের হত্যা করছে ওর বৌর তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে আমাদের জন্য রান্ন া করবে। এই দাওয়াতের শেষ অংশে একটা বিশেষ অনুরোধ ছিল। বাহার প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, সে গরিব মানুষ। তার স্ত্রী আমাদের সবাইকে (44জন) খাওয়াতে চায় কিন্তু তার আর্থিক সঙ্গতি নেই। আমরা 4/5জন যেন যাই। আমি বিব্রত। তারপরও রাজি হলাম।
দুই কোঠার ছোট্ট একটি ঘর। মাঝখানে তরজার বেড়া। আয়োজন সীমিত হলেও খাবার ছিল বেশ উপাদেয়। আমরা ক'জন পেট ভরেই খেলাম। বাহার ও তার স্ত্রীর আতিথেয়তা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো। এ যাবত বাহারের স্ত্রী আমাদের সামনে একবারও আসেনি। খাবার শেষ হওয়ার পর বেড়ার ওপাশ থেকে বাহারের স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে দেহের অর্ধাংশ বের করে দাড়াল।'আসসালামু আলাইকুম'
15/16 বছরের এক কিশোরী মেয়ে। আমরা সালামের জবাব দিয়ে বললাম'আপনার রান্না খুবই মজার হয়েছে। আমরা পেট ভরে খেয়েছি।'
এ জবাবে একটা ধন্যবাদ আসার কথা। কিন্তুগ্রামে বোধহয় এ ধরণের ধন্যবাদের চল নেই। খাবারের আয়োজন ঠিকভাবে করা হয়নি, আদর-আপ্যায়নের অভাব ছিল- স্বাভাবিক লৌকিকতার এ ধরণের কোনো কথাই সে আর বলল না। কিছূক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলবে ভেবে আমরাও চুপ করে রইলাম।
'স্যার আমাদের উনি কি ভালো যুদ্ধ করে না?'
'কেন, বাহার তো খুবই ভালো যুদ্ধ করে। ও খুবই সাহসী' আমি অপ্রস্তত হয়ে বললাম।
'তাহলে যে স্যার এই কয়দিন উনি বাড়িতে। আপনারা ওনারে যুদ্ধে নেন না?'
একি অনুযোগ! বিস্মিত হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। এ প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহী উত্তর আছে কিন্তু সে উত্তর এ মেয়ের বুঝবার কথা নয়। মুখ দিয়ে আমাদের কারোরই কথা সরছে না। ঠিক এ অবস্থায় পড়ব আমাদের কারোরই বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। অপলক নয়নে সদ্য পরিণীতা কিশোরী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা কেউই বয়সে বিশের কোঠা ছাড়াইনি। মেয়েটি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, না আরও কিছু বলবে অনুমান করতে পারছি না। তবে সে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, ঘোমটা মাথায় ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। যুদ্ধ যে নির্ঘাত মৃতু্যর এক সমূহ সম্ভাবনা এ কিশোরীরও তা না জানার কথা নয়। কোন প্রনোদনা যুবক স্বামীকে সেই মৃতু্যর সামনে দাঁড় করাতে উৎসুক? এ কেমন ভালোবাসা?
মনে মনে বললাম, 'শোন মেয়ে। যতদিন তোমরা আছ, যতদিন তোমাদের মতো অন্তপুরের যোদ্ধারা আমাদের মতো সৈনিক তৈরি করবে ততদিন এ জাতির ভাবনার কিছু নেই, আমাদের এগিয়ে যাওয়াও থামবে না। কিছু রক্ত অবশ্যই ঝরবে, কিজানি তোমার পিন্ধনেও হয়তো বা সাদা শাড়ি উঠবে তবে তোমার এ ছোট্ট ঘরে একটা বড় লাল-সবুজ পতাকা আমরা উড়াব ইনশাল্লাহ।'
সূত্র :বিজয়ী হয়ে ফিরব, নইলে ফিরবই না (মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া), পরিচ্ছদ (ভিন্ন রকম ভালোবাসা)
Post a Comment